সেই সাদাকালো সময়টার কথা মনে পড়ে? যখন পাতলা কাগজ পাতা বেঞ্চে লাইন ধরে বসত সার সার শালপাতারা। কোমরে গামছা এঁটে ভুরিভোজের গামলা নিয়ে ঘোরাঘুরি করত গাঁয়ের ছেলে ছোকরারাই। আর পাত পেড়ে চেটেপুটে খেয়ে চলত গ্রামেরই সহজ সরল মুখগুলো। কিন্তু আজকের এই শৌখিনতার যুগে যেন হুট করেই হারিয়ে গেল বাঙালিয়ানার সেই সাবেকি প্রতিচ্ছবিটি। থার্মোকল ও প্লাস্টিকের চটকদারি রূপে মজে শালপাতার চাহিদায় পড়ল ক্রমশ ভাঁটার টান। আর সেই সাথেই পিছিয়ে পড়ল সেই মানুষগুলো যাঁদের রুটিরুজির জীবন পরিবেশন হয় রোজ ওই শালপাতার থালায়। যাঁরা আজও শালপাতার থালা তৈরীর এই ক্ষুদ্র শিল্পকেই আঁকড়ে বাঁচেন নিরন্তর। আজ তেমনই এক মানুষের একচালা সংসারের সামনে দাঁড় করাবো আপনাদের।
ঝাড়গ্রামের জামবনি ব্লকের অন্তর্গত এক প্রত্যন্ত গ্রাম বড় হরকী। যেখানে বাংলার আদিবাসী লোধা সম্প্রদায়টির বহু প্রজন্মের বাস। আর সেই গ্রামেরই বাসিন্দা হলেন প্রেমচাঁদ শবর। যাঁর একহাতে রয়েছে বাংলা অনার্সের ডিগ্রী আর অন্য হাতে কম্পিউটারের প্রশিক্ষণ পত্র। কিন্তু তাতে কি যায় আসে! গরিব সংসারে শিক্ষার দামই বা কতটুকু? সংসারের হাল শক্ত করতে তাই রাতদিন এক করে তিনি সাজিয়ে চলেছেন শালপাতার কুটির শিল্পটিকে।
সাতসকালে বাড়ির মেয়ে বউরা জঙ্গল ঘেঁটে তুলে আনে রাশিকৃত শালপাতার পুঁটলি। আর তার থেকে বাছাই করে থালা বানিয়ে চলেন প্রেমচাঁদবাবু ও তাঁর বাড়ির পুরুষেরা। আর বোঝাই বোঝাই থালা নিয়ে হাজির হন গিধনির বড় বাজারে। তবে তিনি একা নন। ৮০ বছরের ঠাকুমা থেকে ছোট্ট বাচ্চা প্রত্যেকেই সংসারের কাজে খেটে চলেন রোজদিন। আর সারাদিনের ওই রক্তজল পরিশ্রমের মূল্য কত জানেন? ১০০০ পিস থালার জন্য পকেটে ঢোকে মাত্র ২০০-২৫০ টাকা। আর চলতি লকডাউনের বাজারে সেই দাম এসে দাঁড়িয়েছে আজ মাত্র ১৫০ টাকায়। তবে হাল তিনি ছাড়েননি। বাঁচার তাগিদে পাঞ্জা লড়ছেন আজও জীবনের চরম কঠোরতার সঙ্গে।
সমাজের বুকে এমনও কিছু মানুষ থাকেন যাদের দেখলেই বুকে সাহস গজায়। জীবনযুদ্ধে লড়ার অভূত শক্তি সঞ্চয় হয় মজ্জায়। আর তেমন মানুষের এক জ্বলন্ত উদাহরণ হলেন এই প্রেমচাঁদবাবু। অভাবের বাগিচায় দাঁড়িয়েও যাঁর মুখের হাসিটি বিন্দুমাত্র হারায়নি। বরং জীবনের নিষ্ঠুরতাকে উপেক্ষা করেছেন তুড়ি মেরে। সমস্ত গন্ডি ছাড়িয়ে মাথা উঁচিয়ে এগিয়ে চলেছেন আগামীর আলোর দিকে।
Discussion about this post