মা দুর্গার কৈলাস যাত্রার সাথেই শুরু হয়ে হয় মা শ্যামার আগমনের দিন গোনা। কলকাতা সহ বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে মহাসমারোহে পালিত হয় কালিপুজো। তবে কালীপুজো হচ্ছে অথচ মণ্ডপে এক বার “মায়ের পায়ের জবা হয়ে” অথবা “আমার সাধ না মিটিল” বাজবে না, তা প্রায় অসম্ভব। সময়ের সাথে সাথে সঙ্গীতে নানা পরিবর্তন এলেও শ্যামা সঙ্গীত আজও বাঙালির ঐতিহ্যের বাহক। বিভিন্ন সময়ে তৈরী হওয়া শ্যামা সঙ্গীত বরাবরই বাঙালির মন কেড়েছে। পান্নালাল ভট্টাচার্য থেকে রামকুমার চট্টোপাধ্যায় সহ ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, মৃণালকান্তি ঘোষের শ্যামা সঙ্গীত আজও লোকের মুখে মুখে ফেরে। গানগুলির প্রতিটি লাইন যেন বাঙালির জীবনের সাথে গভীর ভাবে যুক্ত। রামপ্রসাদের “আসার আশা, ভবে আসা”, কমলাকান্তের “শ্যামা মা কি আমার কালো”, দাশরথি রায়ের “দোষ কারও নয় গো মা”, রজনীকান্ত সেনের “আমি সকল কাজের পাই হে সময়”-এর মতো গানের সাথে মিশে বঙ্গীয় সংস্কৃতি, লোকাচার, ইতিহাস দর্শন।
রামপ্রসাদ সেনের কথায়, সুশীল ব্যানার্জীর সুরে, পান্নালাল ভট্টাচার্যের- “চাই না গো মা রাজা হতে/ রাজা হবার সাধ নাই মাগো/ দু’বেলা যেন পাই মা খেতে” গানের কথায় প্রথমেই মনে ভেসে আসে বিবেকানন্দের কাহিনী। একসময় যখন বিবেকানন্দ অভাবের তাড়নায় চাকরির জন্য ঘুরে ঘুরে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। প্রিয় নরেনের এ অবস্থা আর চোখে না দেখতে পেরে শ্রীরামকৃষ্ণদেব, তাকে অনুরোধ করেন কালী ঘরে গিয়ে মনের কথা বলার। রামকৃষ্ণ দেবের বিশ্বাস ছিল নরেনকে মা ফেরাবেন না, সে যা চাইবে তাই পাবে। সেইমতো নরেন কালী ঘরে গেলেও ,সে কিছুতেই মায়ের কাছে জানাতে পারলেন না অন্নসংস্থানের কথা, স্বচ্ছলতার কথা। বদলে কালীমূর্তির দিকে তাকিয়ে তিনি প্রার্থনা করলেন – “বিবেক, জ্ঞান, ভক্তি, দিব্য দর্শন।” নরেনের এই কান্ড দেখে রামকৃষ্ণ বলেছিলেন, “আচ্ছা, যা তোর ভাত কাপড়ের অভাব হবে না।”
জানা যায়, উনিশ শতকে কালীকে ঘিরে যে দার্শনিক বিতর্ক হয়েছিল, তার সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ-নিবেদিতা। রক্ত চায়, হিংসা চায়, তাই কালীমূর্তি সমর্থন করতেন না রবীন্দ্রনাথ। অন্যদিকে, বিবেকানন্দ ও নিবেদিতার কাছে মা কালী ছিলেন মৃত্যুরূপা মাতা। সেই সময় কালী-ভাবনা সশস্ত্র বিপ্লবীদের আন্দোলনকেও আলোড়িত করেছিল। শাসক ব্রিটিশদের হত্যা করতে কালী মায়ের নাম নিয়ে বোমা বাঁধতেন দুঃসাহসীরা। কালী পুজোর গানগুলির মধ্যে অন্যতম কালী কীর্তন। প্রায় ১৩৯ বছর পুরোনো হাওড়া জেলার আন্দুল কালী কীর্তন সমিতির হাত ধরে আজও বেঁচে এই অমূল্য শিল্প। একসময় শ্যামা সঙ্গীতের এই মধুর সুরের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন স্বয়ং কাজী নজরুল ইসলাম। তার অনন্য সৃষ্টিগুলির মধ্যে অন্যতম “কালো মেয়ের পায়ের তলায়” বা “বল রে জবা বল” আজও কালীভক্তদের পৌছে দেয় এক অন্য জগতে।
Discussion about this post