” লক্ষ্মীস্তং সর্বদেবানাং যথাসম্ভব নিত্যশঃ।
স্থিরাভাব তথা দেবী মম জন্মনি জন্মনি।।
বন্দে বিষ্ণু প্রিয়াং দেবী দারিদ্র্য দুঃখনাশিনী।
ক্ষীরোদ সম্ভবাং দেবীং বিষ্ণুবক্ষবিলাসিনীঃ।”
আজ কোজাগরী পূর্ণিমা। ঘরে ঘরে মা লক্ষ্মীর আরাধনার দিন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো এই যে, ধনসম্পদ ও ঐশ্বর্যের দেবী অপরূপা লক্ষীর বাহন কেন নিশাচর কুরূপ পেঁচা? শোনা যায়, কোজাগরীর রাতে মা লক্ষ্মী জাগ্রত ব্যক্তিকেই ধনের সন্ধান দেন। যদিও পেঁচা প্রতি রাতেই জেগে থাকে। ঋগ্বেদ অনুযায়ী, পেঁচা হল যমের দূত। ধন উপার্জনের ক্ষেত্রেও সংযমবুদ্ধি ও ধর্মীয় চেতনা জাগ্রত রাখার আবশ্যিকতা বোঝানোর মাধ্যম সেক্ষেত্রে পেঁচা। পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী, যেমন লক্ষ্মী দেবীর বাহন পেঁচা সেরকমই গ্রীক কাহিনী অনুযায়ী পেঁচা হল এথেনার প্রতীক। তিনি লক্ষ্মী দেবীর মতো ধন-সম্পদের দেবী নন বরং, সরস্বতীর মতো জ্ঞানের দেবী । গ্রীক মতে, রাতের অন্ধকারেও প্রখর দৃষ্টির অধিকারী পেঁচা অন্ধকার ও অজ্ঞানতা ঘুচিয়ে দেয় তার দিব্যচক্ষুর মাধ্যমে । এছাড়াও প্রাচীন মিশরের লিপিতে পেঁচার ব্যবহার দেখা যায়। আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ানরা জলদস্যুদের হাত থেকে রক্ষা পেতে পেঁচাকে স্মরণ করতেন বলে জানা যায়।
কথিত রয়েছে, দুর্বাসা মুনির অভিশাপে শ্রীহীন ইন্দ্র সমুদ্রে বসবাস করছিলেন। পরে অন্যান্য দেবতাদের আরাধনায় সমুদ্র মন্থনের সময় উত্থিত হন দেবী লক্ষ্মী এবং বিষ্ণুর বাহুলগ্না হন। চঞ্চলা দেবীর কোনো স্থায়ী বাহন সে সময় ছিল না। কুমারগুপ্তর মুদ্রায় লক্ষ্মীর পাশে ময়ূরকে এবং শশাঙ্ক মুদ্রায় লক্ষ্মীর বাহন হিসেবে কচ্ছপকে দেখা গেছে। কিন্তু বাঙালির পৌরাণিক মতে হাঁস সরস্বতীর ও ময়ূর কার্তিকের বাহন হওয়ায় বলা হয় বাধ্য হয়ে পেঁচাকে বাহন করেছেন লক্ষী। আবার, ধানের সাথে তুলনীয় মা লক্ষ্মীকে ইঁদুরের হাত থেকে রক্ষা করতে নিশাচর পাখি পেঁচাকে যোগ্য বাহনের সম্মান দেওয়া হয়েছে।
জীবনানন্দ দাশের কথায়,
“চারিদিকে নুয়ে প’ড়ে ফলেছে ফসল,
তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা-ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল;
প্রচুর শস্যের গন্ধ থেকে-থেকে আসিতেছে ভেসে
পেঁচা আর ইঁদুরের ঘ্রাণে ভরা আমাদের ভাঁড়ারের দেশে! “
তবে সর্বাধিক গ্রহনযোগ্য মত অনুসারে, লক্ষ্মীর গুণ অর্জন করার হেতু অর্থাৎ সত্য, প্রেম, পবিত্রতা, তপস্যা, তিতিক্ষা পাওয়ার জন্য ‘পেচক ধর্ম’ পালন করতে হবে অর্থাৎ জাগতিক বস্তু থেকে একটু দূরে থেকে নির্জনে যোগৈশ্বর্য ও সাধন সম্পদ রক্ষা করতে হয়। যেমন করে পেঁচা লোকচক্ষুর অন্তরালে বাস করে কারণ, দিনের বেলায় বেরলে অন্যান্য পাখিরা তাকে তাড়া করে। সেরকমই পূর্ণতা লাভ না করা পর্যন্ত সাধনা করতে হয় যাতে জাগতিক বিষয়ের কারণে দৈব সম্পদ নষ্ট না হয়।সাধারণতঃ পৌরাণিক কাহিনী সম্পর্কে বহু মত ও মতবিরোধ থেকে থাকে। এই ক্ষেত্রেও তা অবিচল। তবু যে যে কারণগুলো মূলতঃ পাওয়া যায় তাই এখানে আলোচ্য।
কাজেই বলাই যায়,
“পেঁচায় ভর করে,
মা লক্ষ্মী আসছেন ঘরে ঘরে!”
প্রতিবেদক – জ্যোতি রাণী নাথ
Discussion about this post