তৎকালীন অখন্ড বাংলার ইতিহাসের এক কালো অধ্যায় হিসাবে পরিচিত, ১৯৪৭’র দেশভাগ। দেশভাগের ফলে নিজের ভিটে-মাটি ছাড়া হয়েছিলেন বহু মানুষ। তেমনই তার প্রভাব এসে পড়েছিল স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনৈতিক শাসকদের টানাপোড়েনের মধ্যেও। যদিও দেশভাগের মুখ্য কারিগর একজনই, তৎকালীন ব্রিটিশ শাসক-সরকার। তবে পরবর্তীতে হাতে হাত মিলিয়েছিল কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগও। তবে এই দেশভাগ কিন্তু হঠাৎ করে একদিন ঠিক হয়ে যাওয়া কোনও বিষয় নয়। বরং কিছু মানুষের দীর্ঘকালীন মদতেই ঘটে এমন এক ট্র্যাজেডি।
তবে এসবের মধ্যেই আরেকটি অধ্যায় কিন্তু প্রচারের আলো না পেয়ে আঁধারে মুখ লুকিয়েই পড়ে থাকে। সে অধ্যায়ে রয়েছে দেশভাগ রদের প্রয়াস এবং তার জন্য নেওয়া উদ্যোগ। তৎকালীন কলকাতার নামী কিছু বাঙালিই নিয়েছিলেন এই উদ্যোগ। অবশ্য সফল যে হননি তা আজ বলাই বাহুল্য! যদিও সে প্রয়াস পুরোপুরি নিঃস্বার্থ ছিল না; তবুও তাঁদের তো কুর্নিশ জানাতেই হয়…
ভারতের স্বাধীনতা লাভ যে শুধু কিছু সময়ের অপেক্ষা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই এ কথা প্রায় নিশ্চিত হয়েই গিয়েছিল। তবে সমস্যা ছিল অন্য। ভারত স্বাধীন হতে গেলে পাঞ্জাব এবং বাংলাকে অবিভক্ত রাখা চলবে না। অর্থাৎ বাংলাকে ভাগ করতেই হবে। আপাতকালীন সিদ্ধান্ত হিসাবে হিন্দু অধ্যুষিত রাষ্ট্র হিসাবে ভারত এবং মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ব পাকিস্তান, এই দুই রাষ্ট্রে হতে চলেছিল এই দেশভাগ। স্বাভাবিকভাবেই বাংলাও পড়েছিল এই দেশভাগের করচায়। তবে দেশভাগের জন্য আসলে দায়ী কে? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে গেল নজর ফেরাতে হবে ‘৪৭ এর আগেই।
পূর্বে ঐতিহাসিকরা মনে করতেন মহম্মদ আলী জিন্নাই একমাত্র চেয়েছিলেন এই দেশভাগ। মুসলিম সার্বভৌমত্ব বিশিষ্ট রাষ্ট্র হিসাবে পূর্ব পাকিস্তানের দাবী জানান তিনি। তাঁর ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ বা ‘টু নেশনস থিয়োরি’র ওপর ভিত্তি করেই তিনি তাঁর দাবী রাখেন। সেসময় কংগ্রেসের বিভিন্ন নেতারাও কিন্তু এর বিরোধিতা জানান। দ্বিজাতি তত্ত্বের মূল ভিত্তি ছিল, হিন্দু এবং মুসলিম যেহেতু দুটি আলাদা জাতি। তাই দুটি জাতির জন্য আলাদাভাবে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের একান্তই প্রয়োজন। বলা যেতে পারে ‘৪০ সালের ‘লাহোর প্রস্তাব’-এর মাধ্যমেই জিন্না এই রাজনীতি শুরু করেন। তবে এই দ্বিজাতি তত্ত্বের আরও গভীরে যদি ঢোকা যায় তাহলে দেখা যাবে, ১৯২০ সালে হিন্দু মহাসভা গঠনের সময়ও সাভারকার এর কিছুটা আভাস দিয়েছিলেন। যদিও সেসময় তা বাস্তবায়িত হয়নি।
১৯৪০’য়ে জিন্নার প্রস্তাবের পর কংগ্রেস এর বিরোধিতাও করে। বিশেষ করে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ এবং খান আবদুল গফফর খাঁ ওরফে সীমান্ত গান্ধী সেখানে এক মুখ্য ভূমিকাই পালন করেন। এখন তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে শুধুই কি জিন্নাই তবে দেশভাগ চেয়েছিলেন? এও কিন্তু এক বিতর্কিত বিষয়। কিন্তু দেশভাগ চেয়েছিলেন কি চাননি এর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল তিনি দেশভাগ কেন চেয়েছিলেন? এর পিছনেও রয়েছে কারণ। ‘৪০ এর দশকে বসেই জিন্না বুঝতে পেরেছিলেন ভারতবর্ষ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে উত্থাপিত হলে ক্ষমতার প্রসঙ্গে তার নাম কোথাও থাকবে না। অর্থাৎ স্বাধীন ভারতের শাসব ব্যবস্থা তাঁর আয়ত্তেই থাকবে না। ঠিক সেই কারণেই তিনি আলাদা একটি রাষ্ট্র চেয়েছিলেন যেখানে শাসকের ভূমিকায় তিনি নিজেই হাল ধরতে পারবেন। তবে এখানেও একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলাই চলে। তিনি চেয়েছিলেন দেশভাগ হলে কলকাতা যেন পূর্ব পাকিস্তানের আয়ত্তে থাকে। যদিও পরবর্তীতে দেশভাগের পর সেটি সম্ভব হয়নি। যে কারণে জিন্না এও উক্তি করেছিলেন, “আমাকে পোকায় কাটা পাকিস্তান দেওয়া হয়েছে” ইত্যাদি…
ফিরে আসা যাক ‘৪৭-এর দেশভাগের প্রসঙ্গে। তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সুরাবর্দী খান মাউন্টব্যাটেনের কাছে প্রস্তাব পাঠান; যাতে দেশভাগ হলেও বাংলাকে ভাগ না করে সেটিকে যেন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে সার্বভৌমত্ব দেওয়া হয়। মাউন্টব্যাটেন তাতে রাজিও হন। জানান, যদি কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগ রাজি থাকে তাহলে তাদের কোনও আপত্তিই নেই সেখানে। এদিকে জিন্নাও তখন সেই প্রস্তাবে রাজি হন। অন্যদিকে, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর দাদা প্রায় শুরুর থেকেই দেশভাগের বিপক্ষেই ছিলেন। তবে তিনিও চেয়েছিলেন যদি দেশভাগ করতেই হয় তাহলে ভারতের মধ্যে থাকলেও বাংলা যেন এক স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। অর্থাৎ দেশভাগ করতে হলে মোট তিনটি রাষ্ট্র গঠন করতে হবে- ভারত, পূর্ব পাকিস্তান এবং স্বাধীন বাংলা। তবে তাঁর প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল একটাই, এই সামগ্রিক দেশভাগই রদ করা। এই মর্মে একটি বৈঠকও হয় তাঁর বাড়িতে। সেই বৈঠকের ভিত্তিতে সুরাবর্দী খান, ফজলুর হক সহ আরও অনেকেই সেসময় তাঁর সঙ্গে একমত হন। তবে তাঁদের মধ্যে একটি চুক্তিও হয় পরবর্তীকালে যা ‘বসু-সুরাবর্দী প্রস্তাব’ নামে পরিচিত।
জিন্নার কাছে এ প্রস্তাব রাখা হলে প্রাথমিক ভাবে তিনি সম্মতি জানালেও এর তীব্র বিরোধিতা করেন কংগ্রেসের তৎকালীন নেতাগণ। কারণ ততদিনে তাঁরা বুঝে গেছিলেন দেশভাগ হলে ভারতের শাসন ব্যবস্থার হাল ধরতে চলেছে কংগ্রেসই। স্বাভাবিকভাবেই ক্ষমতা দখলের চাহিদায় তখন অখন্ড বাংলা বা স্বাধীন বাংলার দাবী তাঁরা নাকচ করে দেন। এই দলে বাংলার বাইরের জওহরলাল নেহেরু থেকে শুরু করে বল্লভভাই প্যাটেলও ছিলেন। বাংলার মধ্যেও বিধান চন্দ্র রায় এবং আরও অনেক মানুষই তখন বাংলা বিভাগের দাবীতে একমত হয়েছিলেন। অন্যদিকে হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদও চাইছিলেন না এই বাংলা আলাদা করে কোনও স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হোক। তিনিও চাইছিলেন বাংলা ভারতের শাসন ব্যবস্থার আয়ত্তের মধ্যেই থাকুক। এই দাবীর সমর্থন করে লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে একটি চিঠিও লেখেন তিনি৷
অন্যদিকে কংগ্রেসের প্রধান তখন মহাত্মা গান্ধী। তিনিও দেশভাগের এই সিদ্ধান্তকে প্রথমেই মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। তিনি একথাও বলেছিলেন, “আমার মৃতদেহের ওপর দিয়ে দেশভাগ হবে”। এমনকি সিদ্ধান্তের বিরোধিতায় প্রথমেই শরৎচন্দ্র বসুর নাম উঠে এলে, তাঁকে চিঠিতে আশীর্বাদও জানান বাপুজী। তবে শেষমেশ কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগের মধ্যে ক্ষমতার টানাপোড়েনেই উঠে আসে দেশভাগের প্রসঙ্গ। ভারতের হিন্দু প্রধান জেলাগুলি দেশভাগের সমর্থনেই নিজেদের দাবী রাখে। কলকাতাতে এক কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থার আয়ত্তে আনার যাবতীয় উদ্যোগই নেওয়া হয় সেখানে। এরপরই ‘৪৭-এর ২০ জুন বাংলাকে দ্বি খন্ডিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এরপরের ঘটনা প্রায় সবারই জানা। দেশভাগ হল। ভারত এবং পূর্ব পাকিস্তান দুটি আলাদা রাষ্ট্র হিসাবেও পরিচিতি পেল। ভাঙল বাংলাও৷ তবে এই ঘটনাক্রমের স্রোতের অভিমুখ কিন্তু বদলানো যেতেই পারত। যদি ভারতের কংগ্রেস এবং হিন্দু নেতারা সহায়তা করতেন। শরৎচন্দ্র চেয়েছিলেন বাংলাকে খন্ড হওয়া থেকে রক্ষা করতে। কিন্তু তিনি ব্যর্থই হন। কংগ্রেসের কাছে প্রস্তাব নিয়ে গিয়েও অপমানিত হয়ে ফিরে আসেন তিনি। ফজলুর হক, সুরাবর্দী খানের প্রচেষ্টাও শেষমেশ মাঠেই মারা যায়৷ কিন্তু যদি এমনটা হত? যদি তাঁরা পারতেন দেশভাগ রদ করতে? তাহলে হয়তো আজ এক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবেই বিশ্বের দরবারে পরিচিতি ঘটত বাংলার। কে বলতে পারে? এই প্রশ্নের সঙ্গেই আজ জড়িয়ে রয়েছে বহু বাঙালির দেশপ্রেম এবং আবেগ!
তথ্য সূত্র – দেবর্ষি আজাদ, prohor.in
Discussion about this post