শাপলা সপর্যিতা, কথা-সাহিত্যিক, বাংলাদেশ – গৃহে বন্দী বলিনা। বলি গৃহে সমপর্ণ। কর্মহীন বলিনা বলি কর্মবহুল। নিরানন্দ বলি না। বলি আনন্দ উপভোগের সুযোগ। ঠিক এইভাবে যদি দেখা যায় এই অনিচ্ছাকৃত অবসরকে। করোনা ভাইরাসের বিশ্বব্যাপী মারাত্মক আগ্রাসনে যে মহামারী আজ শুরু হয়েছে তার ভালোর দিকটি এটাই। ‘ধ্বংসেরও কিছু তবু অবশেষ থাকে/ চিহ্ন থাকে, আমাদের তাও নেই/ স্মৃতি নেই চিহ্ন নেই শূন্য গৃহাঙ্গন।’ এতো নয়। বরং আমরা পেয়েছি ফিরে কিছু সময়। কিছু অবসর। কিছু প্রিয়তরসঙ্গ কামনায় অধীর মন আজ হয়েছে লাগামছাড়া। ভোরবেলা ঘুম ভেঙেই দৌড়বার আর সারাদিন কাজের ফাঁকে অবহেলায় পড়ে থাকা ঘর, বর, মন, মানুষগুলো আজ হয়ে উঠেছে বহুমূল্যবান। হয়েছে সঙ্গসার্থক। এই বা কম কিসে। আমি বেশ আছি কাজে কাজে লেখায় পড়ায়। সন্তানের সঙ্গ উপভোগের মাত্রাহীন সময়যাপন আমার। আমি এটুকু নিয়েই থাকি, এটুকু নিয়েই বাঁচি। আপনারও থাকুন। নতুন বিশ্বে শুভ সময়ে দেখা হবে আবার। সকলেই নিরাপদে আনন্দে যাপন করুন এই আরাধ্য সঙ্গসুখ-স্মৃতিসুখ-কর্মমুখরতায়।
তাপস বাপি দাস, সঙ্গীত শিল্পী, ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র সদস্য – এ কোন ছুটি? কেমন অবসর যাপন? পলক পড়ুক, না পড়ুক; চাই বা না চাই। চোখের সামনে ঝোলে অনাহারে আত্মহত্যা করা লাশ। কিশোরীর শ শ মাইল হেঁটে চলা রক্তাক্ত পা অবধারিত মৃত্যু। আমার রান্না করার বা শেখার কোনো ইচ্ছে নেই। আমার জন্য জিম নয়। কিন্তু হু (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা) কিংবা আইসিএমআর, এদের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এবং কর্মকর্তারা যা যা বলছেন, আমার নিজের স্বার্থে এবং অন্যদেরও স্বার্থে সব কিছুই আমি মেনে চলছি। সবাইকে অনুরোধ করছি বহু প্রচারিত লকডাউনের ব্যাপারে যে সব বিধি-নিষেধ, সেগুলো মেনে চলতে। ঘরে থাকুন, সবাইকে ভালো রাখুন। নমস্কার।
পিয়ালী পাঠক, দূরদর্শন ও আকাশবাণীর বাচিক শিল্পী – মেয়েবেলার ছাদ ফিরেছে, বারান্দা ফিরেছে। খুব মনে পড়ছে ইস্কুল, কলেজ থেকে ফেরার সময় গোধূলির সূর্যাস্ত দেখতাম। আর আবার এখন দেখছি। বিকেল, গোধূলি পেরিয়ে সন্ধ্যে নামা। পাখির গান শুনছি। নির্মল আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকছি খানিক। পরিবারের মানুষদের সাথে আরো বেঁধে বেঁধে আছি। বাড়িতে আমার শিল্প সৃষ্টির অনুশীলন চলছে। একটু যোগাভ্যাস, পরিমিত খাওয়াদাওয়া আর অবশ্যই বই পড়া। আমাদের অনেক অনুষ্ঠানই ছিলো যেগুলোর বেশিরভাগই পিছিয়েছে কিন্তু এখনও বাতিল হয়নি। অর্থাৎ এখনও আশা রয়েছে। একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। দুই বাংলার মানুষকে বলি, আমরা সবাই গৃহবন্দী।আমরা এখন সবাই নিজেদের ভালো করে গুছিয়ে রাখি। সাবধানে থাকি, সুস্থ থাকি।রমজান মাস এটি পবিত্র, এই সময় ঈশ্বর আল্লাহর কাছে প্রার্থনা আমাদের পৃথিবী আরোগ্য লাভ করুক। চেনা ছন্দে ফিরুক জীবন। ততদিন আমরা গানে থাকি, কবিতায় থাকি। মনপ্রাণ ভরে সংস্কৃতির রস আস্বাদন করি।
দেবস্মিতা দেব, নৃত্য শিল্পী – আজ প্রায় একমাস ধরে আমরা বন্দীদশা কাটাচ্ছি। এই সময় আমরা যারা অসংগঠিত ক্ষেত্রের মানুষ তারা প্রায় প্রত্যেকেই এক ভয়ঙ্কর মানসিক ও অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হচ্ছি। শিল্পীরা তো সবসময় কিছু সৃষ্টি করেন কিন্তু এখন চারিদিকের এই ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতিতে আমাদের শিল্পীসত্ত্বাও প্রায় বিলুপ্তির পথে। তাই বাড়িতে বসে এইসময় নিজেদের শিল্পে শান দিতে হবে। তাই নতুন কিছু ভাবুন, নতুন কিছু করুন।
এই মূহুর্তের বন্দী দশায় যেসব শিল্পীরা আছেন তাদের কাছে আমার একটাই অনুরোধ আগে শিল্পীদের বাঁচাতে হবে তবেই শিল্প বাঁচবে। এই মূহুর্তে অনেকগুলি এরকম রিলিফ ফান্ড তৈরি হয়েছে গোটা পশ্চিমবঙ্গে যারা শিল্পীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। যেমন আমি নৈহাটির বাসিন্দা, এখানে নৈহাটির কেন্দ্রীক অনেক শিল্পীদের সম্মিলিত প্রয়াসে ‘একতাই ঐকতান’ নামক একটি রিলিফ ফান্ড গঠন করে শিল্পীদের পাশে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।তাই আসুন আমরা শিল্পীরা চারপাশের যে সকল মানুষ, সহকর্মী অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন তাদের পাশে দাঁড়াই। আর দুই বাংলার মানুষকে আমার এটাই বার্তা দিতে চাই। বাড়িতে থাকুন, সুস্থ থাকুন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকুন এবং সুদিনের স্বপ্ন দেখুন।
কৌশিক চক্রবর্তী, সঙ্গীত শিল্পী, ‘পৃথিবী’র সদস্য – লকডাউনের আগে থেকেই আমার জীবনে সবসময় লকডাউনই চলে। আমি ঘরকুনো মানুষ, ঘরে থাকতেই ভালোবাসি। আমার বাইরের জগৎ খুব বেশি বড় নয়। আমার বেঁচে থাকার সব সামগ্রী বাড়িতেই রয়েছে। কেউ যদি আমার ফেসবুক প্রোফাইল অথবা পেজ ফলো করেন, তাহলে তিনি দেখবেন লকডাউনের মধ্যেও প্রচুর কাজ করছি। ইতিমধ্যেই দুটি প্রজেক্ট বেরিয়ে গিয়েছে। ‘ক্লাস রুম’ গানটির দশ বছরের উদযাপনের একটি প্রজেক্ট আসছে। তারপরেই আবার আসছে ‘পৃথিবী পালাচ্ছে কোথায়? এভাবেই পর পর কাজ। শুধু শো’গুলোই খুব মিস করছি। এগুলো ছাড়া আমার বাকি জীবন একই রয়েছে। খাচ্ছি-দাচ্ছি, সিনেমা দেখছি, গল্পের বই পড়ছি। একটু গান-বাজনা শেখার চেষ্টা করছি।
আমি দুই বাংলার মানুষকে এই বার্তাই দেবো শারীরিক বিষয় নিয়ে ভাবতে ভাবতে মানসিক রোগী হয়ে যাওয়া। এটা কাঙ্খিত নয়। এই সংকটে একটাই কাজ করার রয়েছে। যে প্রশাসন এই পরিস্থিতি আমাদের পক্ষে আনবার চেষ্টা চালাচ্ছেন, সেটাকে সমর্থন করা। বাড়িতে থেকে দুশ্চিন্তা না করে মনকে সুস্থ রাখা। মন সুস্থ থাকলে শরীরও সুস্থ থাকবে। আমি জানি, ঘরে বসে বসে আমাদের মতো শিল্পীরা শুধু অভয়ই দিতে পারবেন। কিন্তু যারা দিন আনে দিন খায়, সেই মানুষটার অবস্থা খুব খারাপ। আমি তো একা ভেবে কিছু করতে পারবো না। কিছু করার নেই, প্রকৃতির কাছে আমরা কখনও হেরেই যাই। সেই হেরে যাওয়া থেকেই হয়তো আলো দেখতে পাবো। এটাই বলতে চাই দুই বাংলার মানুষকে।
অ্যানি আহমেদ, সঙ্গীত শিল্পী, ‘আ ডট ইন দ্য স্কাই’য়ের সদস্য – এই কোয়ারেন্টাইন পিরিয়ডে আমি আমার বেশিরভাগ সময়ই কাটাচ্ছি ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’-এর মাধ্যমেই। যেহেতু আমি একজন অঙ্কের শিক্ষিকা, তাই শিক্ষার্থীদের পড়িয়েই সময় কাটছে আমার। নিজের রিসার্চের কাজের সঙ্গেই বাড়ি থেকে গানের নানা কাজও করছি। নিজের জন্যও কিছুটা সময় রেখেছি। নিয়ম করে প্রতিদিন ছাদে উঠছি।
এই সময় ভার্চুয়াল জ্যামিং খুব ট্রেন্ডিং। আমার ব্যান্ড মেট ‘আ ডট ইন দ্য স্কাই’ ব্যান্ডের সুদীপ্ত পালের সঙ্গে এই কোয়ারেন্টাইন পিরিয়ডে আমাদের একটি ভার্চুয়াল জ্যামিং হয়েছে। সেখানে সুদীপ্ত পাল, ক্যাকটাস ও মরূদ্যান খ্যাত পটার সঙ্গে বাংলাদেশের তাসফিয়া ফতিমা তাসফিও উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও আমি সারাদিনে প্রচুর গান শুনছি। সকলকে একটা কথাই বলতে চাই, লকডাউনে বাড়িতেই থাকুন। অনেক গান শুনুন, বই পড়ুন, এক্সারসাইজ করুন, টিভি দেখুন। নিজের পরিবার ও নিজেকে সময় দিন। এই কঠিন সময়ে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী অবশ্যই মানুষের পাশে থাকুন। এভাবেই মন ভাল রাখুন। সুস্থ থাকুন।
Discussion about this post