“আমি ভয় করব না ভয় করব না, দু’বেলা মরার আগে মরব না, ভাই, মরব না।” রবি ঠাকুরে লেখা এই লাইন দু’টি কত মানুষের জীবনে এক বিশাল অনুপ্রেরণা। পৃথিবীতে প্রত্যেক মানুষ প্রতিনিয়ত নিজেদের মতো লড়াই করে চলেছে। তার মধ্যেই কিছু মানুষের লড়াই একটু বেশি কঠিন হয়৷ যা শুধু সমাজের সাথে না বরং নিজের প্রতিবন্ধীকতার সাথেও। আর কিছু মানুষ জীবনের এই বাধা বিপত্তি গুলোকেই বানিয়ে নিয়েছে সেই লড়াইয়ে টিকে থাকার অস্ত্র। এমনই এক লড়াকু মেয়ে হলো আবৃত্তিকার দেবস্মিতা নাথ।
দুর্গাপুর শহরের ছোট্ট মেয়ে দেবস্মিতার জন্ম হয় ২০০১ সালে। কিন্তু যে বয়েসে বাকি বাচ্চারা রীতিমতো হাঁটতে পারে সেই বয়েসে ছোট্ট দেবস্মিতা ঠিক করে বসতেও পারত না। দেবস্মিতার মায়ের জন্য ব্যাপারটি ক্রমশ উদ্বেগের কারণ হয়ে ওঠে। শুরু হয় ডাক্তার দেখানো। জানা যায় দেবস্মিতা নাকি বাকি পাঁচটা স্বাভাবিক বাচ্চার মতো না। সে স্পেশ্যাল, সে বিশেষ। চিকিৎসার জন্য তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ভেলোরে। চিকিৎসকদের পরামর্শ মতো বাড়িতে শুরু হয় ফিজিওথেরাপি এবং তাদের কথা মতোই দেবস্মিতাকে রাখা হল গান, কবিতা ইত্যাদি শিল্পের মাঝে। ধীরে ধীরে হলেও হাঁটতে এবিং কথা বলতে শিখলো সে। সুনীতা দেবী জানতেন এই লড়াই সহজ নয় তো বটেই, সাথে সুদীর্ঘও। পাশে ছিলেন তাঁর স্বামী।
ছোট থেকেই শিল্পের মধ্যে গান-বাজনার মধ্যে দেবস্মিতা বেড়ে উঠেছে। তবে গান শুনতে ভালোবাসলেও গানের সাথে সখ্যতা তেমন গড়ে ওঠে নি সেভাবে। বরং তৈরি হয় কবিতার প্রতি প্রেম। স্কুলে শেখানো নানা কবিতা দেবস্মিতার খুব ভালো মনে থাকতো। মুখস্থ করে বলার ক্ষমতাও ছিল। তার কবিতা উপস্থাপনের পদ্ধতিও ছিল বাকিদের থেকে আলাদা। কবিতা প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণের জন্য দেবস্মিতা এই সময় অন্য স্কুলে যায়। ‘লিচু চোর’ কবিতা শুনিয়ে জিতে নেয় সেখানে দ্বিতীয় স্থানের পুরস্কার। এরপর থেকে দেবস্মিতার কবিতার প্রতি অদ্ভুত আকর্ষণ জন্মায়। কবিতার প্রতি এমন ভালোবাসা দেখে বাড়িতেই আবৃত্তি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন সুনীতা দেবী। স্কুলের কিছু শিক্ষিকা থেকে সমাজের নানা বাধা বিপত্তি পেরিয়েছে। আস্তে আস্তে সুযোগ হয় বিভিন্ন লোকাল টিভির অনুষ্ঠানে এবং পুজোর প্যান্ডেলে আবৃত্তি পরিবেশনা করার। ১৩ বছর বয়েসে দুর্গাপুরেই ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ওয়ার্কশপ করার সুযোগ হয়। তারপর থেকে সে আর কখনো থেমে থাকেনি। ক্রমেই পড়াশোনার পাশাপাশি দাপিয়ে মঞ্চ অনুষ্ঠান করতে থাকে দেবস্মিতা। ১৮ বছর বয়েসে তার প্রথম সিডি রিলিজ হয় ‘তোমায় প্রণমী’, রবি ঠাকুরের লেখা কবিতার সম্ভার নিয়ে। অনেক বড় পুরস্কারগুলির মধ্যে অন্যতম প্রমীলা কৃতী রত্নে তাকে সন্মানিত করা হয়৷
বর্তমানে দেবস্মিতা ইংরেজিতে স্নাতক স্তরের পড়াশুনার পাশাপাশি একজন বাচিক শিল্পী হিসাবে নিজের নেশাকে পেশায় পরিণত করেছে। সে রবি ঠাকুরের সেই উক্তির মতোই রোজ মরেনি। দেবস্মিতার পরম বন্ধু তার মা। যিনি তার এই দীর্ঘ লড়াইতে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি। ইচ্ছে থাকলেই যে উপায় হয় তা দেবস্মিতা আমাদের শিখিয়েছে। জীবনের কোনো বিপত্তিতেই হার না মেনে এগিয়ে যেতে শিখিয়েছে দেবস্মিতা। সে বুঝিয়ে দিয়েছে সে সত্যিই আলাদা সকলের থেকে। সে সত্যিই বিশেষ।
Discussion about this post