“হেথা হতে যাও পুরাতন! হেথায় নতুন খেলা আরম্ভ হয়েছে”– কী অবিশ্বাস্য একটি সত্যি কথা আমাদের প্রাণের ঠাকুর বলে গেছিলেন তাঁর জীবদ্দশায়। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমরা যেন এই কথার সত্যতা খুঁজে পাই প্রতি পদে পদে। বদলাচ্ছে মানুষ। বদলাচ্ছে আমাদের চেনা শহর তিলোত্তমা। এখনও এমন অনেক মানুষ আছেন যারা শুধু এই শহরের ঐতিহ্যকে দূর থেকে দেখতে নয়, আসেন একবার হলেও ছুঁয়ে দেখতে বা অনুভব করতে। তিলোত্তমা নিজেই যে আস্ত একটা ইতিহাস। যাকে পড়ার মধ্যে দিয়ে নয়, জানতে হয় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। আজ সেই উপায়ই হারাতে বসেছে ধীরে ধীরে। এক এক করে পাত্তারি গোটাচ্ছে জলজ্যান্ত ইতিহাস। তারই এক অন্যতম উদাহরণ পার্ক স্ট্রিট পোস্ট অফিসের কাছে অবস্থিত কলকাতার প্রাচীনতম অকশান হাউস(নিলাম ঘর) ‘ভিক্টর ব্রাদার্স’। আশি পেরোনো ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানে ক্লোজিং ডাউন সেল।
শহরটা দিনে দিনে আধুনিকতার মোড়কে মুড়তে শুরু করলেও দোকানের প্রতিটা কোণে যেন ছড়িয়ে রয়েছে পুরনো দিনের নিদর্শন। ধুলোর আস্তরণে ঢেকে গেলেও যত্ন করে সাজানো রয়েছে ভিক্টোরিয়ান চায়ের সেট, টেবিল ল্যাম্প, শৌখিন মোমদানি। এছাড়াও চাইনিজ ফুলদানি, ঝাড়বাতি, রৌশনদান, ব্রিটিশ ক্যামেরা, তাদের প্রতীক চিহ্ন, জামাকাপড়, বার্মাটিকের আসবাব, স্ক্র্যাপ মেটালের গাড়ি ও আরও কত কি! দুর্মূল্য অ্যান্টিক জিনিস ও অসাধারণ কারুকার্যের আসবাবের পসরা সাজানো ভিতরের মায়াবী জাদুঘরে।
হালআমলে অবশ্য কেউ একটা এই জাদুঘরে চট করে ঘুরে আসার কথা ভাবতেন না। আবার সকলের সাধ্যের ব্যাপারটাও ভাববার বিষয়। তবুও এসব জিনিসের কদর করা কিছু সাধ্যবান ক্রেতারা ভিড় করতেন প্রতি রবিবার। সেই দিন এই নিলাম ঘর কাঠের হাতুড়ির ঘায়ে গমগম করে উঠত ‘সোল্ড’ শব্দ। অনেকেই শুধুমাত্র নিলাম দেখার লোভে হানা দিতেন সেখানে। কিন্তু সেসব মানুষের আবেগকে চিরতরে মুছে দিতে দোকানের বাইরে এখন ঝুলছে ‘Closing Down Sale’ লেখা বোর্ড। এখন দুনিয়াটাই চলছে ‘ফেলো কড়ি, মাখো তেল’ প্রবাদের ভরসায়। তাই কদিন বাদেই হয়তো অকশান হাউসের জায়গায় গড়ে উঠবে শপিং মল, ঝাঁ চকচকে ক্যাফে বা বিলাসবহুল কোনো অ্যাপার্টমেন্ট।
সেল মানেই আমাদের কাছে দারুন আকর্ষণীয় একটা ব্যাপার। অনেকেই অপেক্ষায় থাকেন সেলের। কিন্তু ভিক্টর ব্রাদার্স-এর সামনে ক্লোজিং ডাউন সেল লেখা সাইন বোর্ড দেখে অনেকেরই চোখ হাল্কা হলেও ভিজছে কান্নায়। এভাবেই আস্তে আস্তে আমাদের চেনা তিলোত্তমাটা মুছে যাচ্ছে। বিশ্বায়নের গ্রাসে এভাবেই হয়তো মিলিয়ে যাবে কলকাতার হেরিটেজগুলো। নস্টালজিয়া নিয়ে আমরা এখন কাব্য বা লেখালেখি করি, কিন্তু তাকে বাঁচাতে পারি কি? তাই যতদিন সুযোগ রয়েছে কলকাতার মধ্যে থাকা আরেকটা কলকাতাকে কদর করাই ভালো। মানুষ চলে গেলেও যাতে পরের প্রজন্ম স্থাপত্য দেখেই বড়াই করতে পারে নিজের শহরকে নিয়ে।
Discussion about this post