১৭৭৬ সালে ৪ঠা জুলাই ব্রিটেনের রাজনৈতিক নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে আমেরিকার প্রাণপুরুষরা একটি ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এর ফলে আমেরিকান জনগন তাদের নেতা তথা রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচিত করতে সক্ষম হন। সেই অনুযায়ী ১৭৮৮-৮৯ সালের প্রথম নির্বাচনে জর্জ ওয়াশিংটন আমেরিকার প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। বর্তমানে বিশ্বের প্রাচীনতম গণতন্ত্রের নির্বাচন প্রতি ৪ বছর অন্তর নভেম্বর মাসের প্রথম মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হয়। যদিও ১৭৮৯ থেকে ১৮৪০ সাল পর্যন্ত এই নির্বাচন প্রতি ৪ বছর অন্তর নভেম্বর মাসের প্রথম মঙ্গলবার থেকে শুরু করে ডিসেম্বর মাসের প্রথম বুধবারের মধ্যে অনুষ্ঠিত হত। এই সময়ের মধ্যে যে কোনও দিন আমেরিকার প্রদেশগুলি তাদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে পারত। কিন্ত এতদিন ধরে চলা নির্বাচনে কিছু ত্রুটি লক্ষ্য করা গিয়েছিল। প্রথম দিকের ভোটদানের ফলাফল পরের দিকে অনুষ্ঠিত হওয়া বাকি প্রদেশগুলির নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে থাকে। তাই মার্কিন কংগ্রেস ১৮৪৫ সালে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় আইন পাস করিয়ে ঘোষণা করে, পরের নির্বাচনগুলি গোটা মার্কিন মুলুকে একই দিনে সম্পন্ন করতে হবে।
তবে প্রশ্ন হল কেন আমেরিকার নির্বাচন মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হয়? আসলে উনিশ শতকের সেই ভোটগ্রহণ কেন্দ্রগুলি লোকালয় থেকে অনেক দূরে অবস্থিত ছিল। সাধারন মানুষের বেশিরভাগ ছিলেন কৃষিজীবী। তাই তাদের অনেকটা রাস্তা পায়ে হেঁটে ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে আসতে হত। মঙ্গলবার ভোটদানের জন্য সোমবার দিনটি তারা যাত্রা করতে। আবার যেহেতু বুধবার দিনটি ছিল কৃষকদের হাট-বাজারের দিন এবং আমেরিকার জনগণ সপ্তাহ শেষে গীর্জাতে সময় কাটাতে পছন্দ করতেন। তাই মঙ্গলবার দিনটিই অবশেষে ভোটগ্রহণের জন্য ধার্য হয়।
আমেরিকার নির্বাচনী ইতিহাসে কোন বিতর্ক থাকবে না এমন নয়! বিশ্বের সব থেকে শক্তিশালী ও উন্নত রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিত আমেরিকাতে এখনও বর্ণ বৈষম্য রয়েছে প্রবলভাবেই। প্রতি নির্বাচনেই কমবেশি এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এই বৈষম্য আমেরিকার প্রথম নির্বাচন থেকে চলে আসছে। আমেরিকার প্রাণপুরুষরা ভোটদানের অধিকার দিয়েছিলেন শুধুমাত্র সাদা চামড়ার প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষদের। ১৮৬০ সালের পর ভোটদানের অধিকার কালো চামড়ার মানুষদের দেওয়া হলেও ১৮৭০-এর দশকের প্রথম দিকে সাদা চামড়ার মানুষ কুখ্যাত ‘গ্র্যান্ড ফাদার ক্লজ’ চাপিয়ে দেওয়া হয় কালো বর্ণের মানুষদের ওপর। বলা হয় যেসব আফ্রো-আমেরিকানদের ঠাকুরদা ১৮৬৭ সালের আগে ভোট দিয়েছে তাদের পরবর্তী প্রজন্ম ভোট দিতে পারবেন। এই বর্ণবৈষম্য ব্যালট বাক্স থেকে কালো চামড়ার পুরুষদের ১৯০০ সাল পর্যন্ত দূরে রেখেছিল। এমনকি কালো চামড়ার মহিলাদের ১৯২০-র দশক পর্যন্ত দূরে সরিয়ে রেখেছিল।
চলতি মার্কিন রাস্ত্রপতি নির্বাচনেও বর্ণবৈষম্য অবশ্যই একটি অন্যতম ইস্যু। বেশ কিছু দিন আগে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা যেখানে একজন সাদা চামড়ার পুলিশ কালো চামড়ার জর্জ ফ্লয়েডকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এরকম ঘটনা বহুবার ঘটেছে আগেও। তাই প্রতিবাদ হিসেবে শুধু আমেরিকাতেই নয়, বিশ্বের নানা প্রান্তে আন্দোলন শুরু হয় ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’। এছাড়াও হাল-আমলের অতিমারী পরিস্থিতিতে মানুষ চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছেন, অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও খারাপতর হয়ে উঠেছে। এই অবস্থায় নির্বাচনে বর্ণবৈষম্য সমস্যাটি প্রভাব ফেলেছে বলেই মনে করা হচ্ছে। তাই জো বাইডেন কিংবা ট্রাম্প, হোয়াইট হাউজ যিনিই দখল করুন, অন্ততঃ মার্কিন মুলুকের বর্ণময় নির্বাচনের ইতিহাসের মতোই ভবিষ্যতেও পদচিহ্ন রেখে যাবে ‘বর্ণবৈষম্য’ ইস্যুটি।
প্রতিবেদক স্নিগ্ধদেব গাঙ্গুলী
Discussion about this post