১৯৩০ সালের মার্চ মাসে বাসন্তী ও অন্নপূর্ণা পুজোর উপলক্ষ্যে ‘বসন্তেশ্বরী’ নামক একটি অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়েছিল বেতারে৷ ভারতীয় বেতার মাধ্যম ততদিনে এসে গেছে সরকারি হেফাজতে। এই ‘বসন্তেশ্বরী’ অনুষ্ঠানটির পিছনে ছিলেন বাণীকুমার। তাঁরই রচনা, প্রযোজনা ও শ্লোক আবৃত্তি এবং হরিশচন্দ্র বালী ও রাইচাঁদ বড়ালের সুর৷ এটি জনপ্রিয় হওয়ায়, ঠিক হয় দুর্গা পুজোতেও আর একটি অনুষ্ঠান হবে। পাঠ হবে চণ্ডী স্তোত্র। বলা বাহুল্য, সে সময় ব্রাহ্মণ ছাড়া হিন্দু পূজাচার ভাবাই যেত না। অথচ, এই অনুষ্ঠানে স্তোত্র পাঠ করলেন এক কিম্ভূত গলার অধিকারী অব্রাহ্মণ। রে রে করে উঠেছিল রক্ষণশীল গোঁড়া হিন্দুরা। কিন্তু সেসবের ধার ধারেননি আমাদের প্রিয় কণ্ঠশিল্পী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।
ছোটবেলাতেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল গলা। কারণ? ‘ডিপথেরিয়া’। সাহেব ডাক্তার জীবনটা বাঁচাতে পারলেও, গলাকে আবার আগের অবস্থায় ফেরাতে পারেননি। ফলে ছোট থেকেই গলার স্বর ছিল ভাঙা-ফাটা, যাকে ইংরেজিতে বলে ‘হাস্কি’। কিন্তু পছন্দ ছিল ওই কথা বলার কাজটিই, অর্থাৎ কন্ঠশিল্পী হয়ে মানুষের কাছে পৌঁছনোর কাজটি। নষ্ট হওয়া কিম্ভূত গলা নিয়ে তা হবে কেমন করে! রেডিওর অডিশনেও ফেইল। শেষ পর্যন্ত ডাক এসেছিল ভূত আর রাক্ষসের গলা করবার জন্য। এই দিয়েই রেডিওর কণ্ঠশিল্পীর জীবন শুরু করেছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।
১৯৩১ সালে বাণীকুমার, ওরফে বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য্য মহালয়ার অনুষ্ঠানে চণ্ডীপাঠের দায়িত্ব দিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে। লোকে বলল ‘কায়েতের ছেলে করবে চণ্ডীপাঠ?’ কিন্তু অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা এসবে কান দিলেন না। তাঁরা বললেন, অনুষ্ঠানে বাদ্যযন্ত্রে যাঁরা সঙ্গত করছেন, তাঁরা সকলেই প্রায় অব্রাহ্মণ এবং মুসলমান। তাহলে তাঁদেরকেও বাদ দিতে হয়। শেষ পর্যন্ত বীরেন্দ্রকৃষ্ণ চণ্ডীপাঠ করলেন, সারেঙ্গী বাজিয়েছিলেন মুনশি, চেলি বাজিয়েছিলেন আলি, হারমোনিয়ামে সুর তুলেছিলেন খুশি মহম্মদ। হিন্দু, মুসলিম এবং খ্রিস্টান সমস্ত ধর্মের শিল্পীদের নিয়েই হয়েছিল রেকর্ডিং। তখন রেকর্ডিং ব্যবস্থা ততখানি আধুনিক না হওয়ায় শিল্পীরা সকলেই প্রায় আন্দাজে খোল, করতাল, বেহালা বাজিয়েছিলেন। কিন্তু রেকর্ডিংয়ের পর শুনতে কোথাও বেসুরো লাগে নি। সুরও যেন বিরাজ করেছিল এক অদ্ভুত সম্প্রীতির মধ্যে।
সম্প্রচারিত হল অনুষ্ঠান। দুই ঘণ্টা পনেরো মিনিট দীর্ঘ, এমন বেতার অনুষ্ঠান সম্ভবত পৃথিবীর অন্যত্র আর কোথাও হয় নি। ‘কায়েতের গলায় চণ্ডীপাঠ’ শুনেই আবেগে ভেসে গেল বাঙালি। আজও সেই আবেগে কোথাও এক বিন্দুও ভাঁটা পরেনি। বিসমিল্লাহ খানের সানাই আর মুসলমান কারিগরদের তৈরি বেনারসী শাড়ি ছাড়া যে হিন্দু বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠানই পরিপূর্ণতা পায় না, সেখানে চণ্ডীপাঠের গলা ব্রাহ্মণ নাকি অব্রাহ্মণের, সেই প্রশ্নই হাস্যকর। ফলে, আজ থেকে একশ বছর পরেও কায়েতের গলায় ‘আশ্বিনের শারদ প্রাতে…’ শুনেই যে বাঙালির গায়ে কাঁটা দেবে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
Discussion about this post