করোনা ত্রাসে আজ যা ‘সামাজিক দূরত্ব’, সাঁওতাল সমাজে সেই রীতি চালু আবহমানকাল ধরেই। আদিবাসীদের ডব জোহার, লোটাদা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার প্রথা! অতিথি অ্যাপ্যায়নে এই সামাজিক প্রথা আজও প্রাসঙ্গিক করোনা ভাইরাস রুখতে। বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক সুরজিত সিং হাঁসদা বলেন, আজকের বিজ্ঞান যা বলছে, আমাদের পূর্বপুরুষরা তা বলে গিয়েছিলেন। আধুনিক সভ্যতার করমর্দন নয়। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ‘লোটা দাহ’ করে জীবাণু নাশক হয়ে তবেই গৃহে প্রবেশের নির্দেশ ছিল। আদিবাসী সমাজে এই রীতি চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। যে কোনও আদিবাসী গ্রামে গেলেই এই প্রথা দেখা যায়।
অতিথি আপ্যায়নের রীতি এই ‘ডব জোহার’। যেখানে বাড়িতে কেউ অতিথি এলে তাকে বাড়ির বাইরে দড়ির খাটিয়া, মাচুলি বা চেয়ারে বেশ কিছুক্ষণ বসতে দেওয়া হয়। তারপরে কাঁসার ঘটিতে জল এনে তাকে হাত-পা ধুতে জল দেওয়া হয়। যাকে বলে লোটাদা। দুটি প্রক্রিয়ার শেষে বেশ কিছুক্ষণ বাইরে বসে থাকার সময় পরিবারের খবর নেন বাড়ির বাকি সদস্যরা। অতিথি বয়স্ক হলে তাকে প্রণাম করেন দূর থেকে। ছোটরা অতিথি বাড়িতে আসা বড়দের প্রণাম সারে, তবে দূর থেকেই। তারপরেই তাদের বাড়ির ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হয়। এরপর অতিথি ‘লোটা’ থেকে মেঝেতে সামান্য পরিমাণে জল ফেলে এবং ‘লোটা দাহ’ নিয়ে বাড়ির কোনায় ধোয়ার জন্য যায়। তারপর পা হাত ও মুখ ধুয়ে ফেলে এবং তার মাথার উপর জল ছিটিয়ে নেয়। যদি কোনো ও উপজাতীয় অতিথি অচেনা ব্যক্তি বাড়িতে আসে তবে তাকে ‘লোটা দাহ’ এর সঙ্গে স্বাগত জানানো হয়। হাত মিলানো বা হ্যাগিং এর মত অভ্যাস সাঁওতালি সংস্কৃতি বিরুদ্ধে হয়। এমনকি বিদেশে যখন সাঁওতাল উপজাতি দের একে অন্যের সাথে অভিবাদন করে তখন ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখে।
‘লোটা’ পবিত্র জল। ‘লোটা দাহ’ কেবল স্যানিটাইজেশন এর জন্য নয় বরং পবিত্রতার জন্য বোঝানো হয়। অতিথিরা ‘লোটা’ থেকে মেঝেতে সামান্য পরিমান জল ঢালে। এই নিয়মটি সাঁওতালি দেবতাদের সেবা করার জন্য করা হয়ে থাকে। মাথার ওপর জল ছিটিয়ে নেওয়া পবিত্রতার বার্তা বহন করে। আবার আসামে সাঁওতালরা অতিথিদের স্বাগত জানান একটু অন্যরকমভাবে। এটি দেখা যায় যে তুলসী পাতা, ‘লোটা দাহ’ এর ভিতর রাখা হয়। যেখানে ‘লোটা দাহ’ রাখা হয় সে জায়গাটি একটি ভেজা কাপড় দিয়ে পরিষ্কার করা হয় যেমন পরিষ্কার করা হয় ‘খন্দ’ বা সাঁওতাল দেবতাদের পুজো করার আগে। সাঁওতালি পবিত্র বই ‘জমসিম বিন্তি’ অনুযায়ী, ‘মানুষ সর্বশক্তিমান (ঠাকুর) পুত্র (বঙ্গ হপন)’। এই কারণেই অতিথিদের সর্বোচ্চ হিসেবে গণ্য করা হয় তুলসী পাতা যোগ করে। ‘খন্দ’ তৈরীর অনুষ্ঠান বিশুদ্ধতা এবং পবিত্রতা যোগ করে।
হাজার হাজার বছর আগে সাঁওতাল সমাজ সংস্কারকরা এই ডব জোহারের রীতি চালু করেছিল। তারা যে কত দূরদর্শী ছিল এই বিজ্ঞান ভিত্তিক রীতি তার প্রমাণ। লেখক লক্ষণ হাঁসদা জানান; অতিথিদের বসতে দেওয়া, ডব জোহার, লোটাদা করার সঙ্গে একটা আন্তরিকতা আছে। তবে তা সামাজিক দূরত্ব রেখেই, যা আমাদের সমাজে এখনও হারিয়ে যায়নি। বনবাসী হিসাবে আমাদের এই পদ্ধতি যে সঠিক তা স্বীকার করছে আজকের সমাজ। আর এটাই আমাদের গর্ব।
Discussion about this post