ভারতবর্ষ বৈচিত্র্যের দেশ। উত্তরে পর্বতমালা থেকে দক্ষিণে সমুদ্র, পশ্চিমে মরুভূমি থেকে পূর্বে সমতল, বৈচিত্রের বাহার পুরো দেশ জুড়েই। পৃথিবীর মানচিত্রে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও সামিল এই বাহারে। আর পাহাড় খুঁজতে গেলে হাতের কাছে উত্তরবঙ্গ তো রয়েছেই। কিন্তু উত্তরবঙ্গে পাহাড় ঘোরা মানে কি কেবল দার্জিলিং, কালিম্পং বা ডুয়ার্স ই? নাহ! এছাড়াও কিছু নাম না জানা পাহাড়ঘেরা ছোট্ট জনপদ কিন্তু মজুত এখানে। হিমালয়ে ঘেরা উত্তরবঙ্গের পেডং এমনই এক জায়গা। মানচিত্রে এর উল্লেখ থাকলেও, পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে কিন্তু এর বিশেষ সুপরিচিতি নেই। কিন্তু পেডং এর নৈস্বর্গীক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আপনার চোখ জুড়াতে বাধ্য।
পেডং পৌঁছানোর যাত্রা শুরু হয় নিউ জলপাইগুড়ি জংশন স্টেশন থেকে। সমতল ছেড়ে এক পাহাড় ছুঁয়ে অন্য পাহাড়ের গা বেয়ে রাস্তা চলে গেছে পেডংয়ের উদ্দেশ্যে। এখানে পাহাড়ের মনোরম সান্নিধ্য গ্রীষ্মেও শীতের আমেজ এনে দেয়। যাত্রাপথের বাঁ-দিকে যেমন পাহাড়ের উচ্চতার হাতছানি, তেমনই ডানদিকে আপন খেয়ালে বয়ে চলেছে তিস্তা। একসময় তিস্তা দৃষ্টির অগোচরে চলে যায়। শুরু হয় ছোট ছোট কিছু পাহাড়ি জনপদ। অবিরাম পথ চলা সত্ত্বেও যাত্রাসুখের এই উল্লাসে পথের শ্রান্তি হার মানতে বাধ্য।
পেডংয়ে ঘুরে ফিরে একটাই পথ। যেটি বাজার, স্কুল, কলেজ ছুঁয়ে পাহাড়ের পাশ দিয়ে এগিয়ে চলেছে। নানা ভাষাভাষী ব্যবসায়ীদের সমাগম হয় এখানে। এক বাঙালি ব্যবসায়ী নিমাইবাবুর সঙ্গে আলাপচারিতায় পেডংয়ের পাশের গ্রামগুলির জীবনশৈলীর কিছু ধারনা পাওয়া যায়। এই স্থায়ী বাসিন্দার বাড়িতে আশপাশের গ্রামের কয়েকজন নেপালী ছাত্রছাত্রী পড়াশুনার জন্য থাকে। তারা নিজেরাই রান্না করে খায়। চাল, ডাল, গ্যাস আর নিত্যপ্রয়োজনীয় সমস্ত সামগ্রীর জোগান দেন নিমাইবাবু। অসুস্থ হলে ডাক্তার-ওষুধের দায়িত্বও নেন তিনিই। বাৎসরিক খরচ হিসেবে ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকরা আনুমানিক ৩০-৩৫ হাজার টাকার বিনিময়ে তাঁকে বড় এলাচ, আদা, গ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে নিয়ে আসা গরুর দুধ এই সমস্ত কিছু দেয়। এইভাবেই কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, অতীতের বিনিময় প্রথা পাহাড়ের জনজীবনে বেঁচে রয়েছে আজও। পেডংয়ে ১৮৩৭ সালে ভুটানিদের গড়া পেডং মনাস্ট্রি এবং ব্রিটিশের হাতে বিধ্বস্ত ভুটানিদের ১৬৮০ সালের ডামসিং দুর্গ দেখতে পাওয়া যায়। পেডং থেকে কাশিং যাওয়ার পথে ৫৪০০ ফুট উচ্চতায় রয়েছে ক্রশহিল। যাত্রাপথে দেখা যায় সিকিমের পাহাড়গুলি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। এখানের অপরূপ শোভা আর মনোরম পরিবেশে হারিয়ে যাওয়া যায় বেশ কিছুক্ষণ। রাজ্য পর্যটনের আনুকূল্যে এখানে বেশ কিছু হোম-স্টে ও গড়ে উঠেছে। আদা এবং বড় এলাচের বাগানও হাজির এখানে।
সুদূর অতীতের ভগ্নপ্রায় প্রাচীন রেশমপথ ধরে এবার যাত্রা এবার কালিম্পং অভিমুখে। এখানে ডেলো পাহাড়ে তিব্বতী বৌদ্ধ মনাস্ট্রির দেয়াল জুড়ে ফ্রেস্কো চিত্রের সমাহার দেখতে পাওয়া যায়। উপাসনা মন্দিরে ধ্যানগম্ভীর বুদ্ধমূর্তি থেকে শুরু করে লামাদের পঠনপাঠনের বিদ্যালয় সর্বত্রই আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়া ঘিরে রয়েছে।
বৃষ্টিস্নাত পেডংয়ের সঙ্গে ঝলমলে রোদ্দুর অবিরাম লুকোচুরি খেলেই চলেছে। মেঘের আনাগোনার মাঝেই হঠাৎ করে নামে বৃষ্টি, আবার পরমুহূর্তেই নরম মিষ্টি রোদের ছোঁয়া। পেডংয়ে বেশ কিছুদিন এভাবেই কাটানোর পর একই পাহাড়ি পথ ধরে নেমে এলেও কোনও একঘেয়েমীর দেখা পাওয়া যাবে না। তাই রোজকার একঘেয়ে জীবনের কর্মব্যস্ততার হাত থেকে মুক্তি পেতে ছুটি কাটাতে পেডংয়ের খোলা হাওয়া আর মনোরম পরিবেশে ঘুরে আসা যেতেই পারে।
কলমে সংঘমিত্রা দে
Discussion about this post