বাংলা ভাষার ওপর অন্য ভাষার আগ্রাসনের কথা আমরা কমবেশি সবাই জানি। কিন্তু সবথেকে বেশি আগ্রাসন নেমে আসে নানা উপজাতিদের আঞ্চলিক ভাষাগুলির ওপর। এমন অনেক আঞ্চলিক ভাষা আছে যার নিজস্ব লিপি নেই। সেইসব ভাষার মানুষের সংখ্যাও কম, ফলে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও বেশি। তেমনি একটি ভাষা হল ‘টোটো’ ভাষা। এই টোটো জনজাতিরই প্রতিনিধি ধনীরাম টোটো তৈরী করে ফেলেছেন টোটোলিপি। যার ফলে সম্প্রতি ভারত সরকারের পক্ষ থেকে ধনীরাম টোটো ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কার পেয়েছেন। ৩৭ টি শব্দের অক্ষররাশি নিয়ে এই লিপি টোটো ভাষাকে লেখার উপযোগী করে তুলেছে।
আলিপুরদুয়ার জেলার মাদারিহাট-বীরপাড়া ব্লকে পৃথিবীর অন্যতম ক্ষুদ্র জনজাতি টোটোদের বাস। যার নাম ‘ টোটোপাড়া’। এই টোটোপাড়াতেই ১৯৬৪ সালে জন্ম হয় ধনীরাম টোটোর। তাঁর প্রথাগত শিক্ষা দশম শ্রেণী পর্যন্ত। কিন্তু খুব ছোটো বয়স থেকেই তিনি টোটো জনজাতির জীবনযাত্রা, টোটোভাষা, প্রাণ-প্রকৃতি সবকিছুর প্রতি টান অনুভব করতেন। তিনি বুঝেছিলেন প্রথাগত শিক্ষায় টোটোদের পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারন হল মাতৃভাষায় লেখাপড়া শিখতে না পারা। একমাত্র বাংলা ভাষাই লেখাপড়ার মাধ্যম। তখন থেকেই টোটো লিপি তৈরীর ভাবনা তাঁকে ভাবায়। ২০০৫ সাল থেকে তিনি পুরোদমে লিপি তৈরীর কাজে লেগে পড়েন। তাঁকে সহায়তা করেন অস্ট্রেলিয়ান ভাষাবিদ টোবি অ্যন্ডারসন। ১০ বছরের প্রচেষ্টার পর ২০১৫ সালে প্রকাশ পায় টোটো ভাষার সম্পূর্ণ বর্ণমালা। তার সেই লিপি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পায়। ধনীরাম এই লিপির নামকরণ করেন ‘ডেংকা’।
এর মাঝেই ধনীরাম লিখেছেন বহু কবিতা, গল্প, রম্যরচনা। লিখেছেন দুটো উপন্যাস ‘ধানুয়া টোটোর কথামালা’ ও ‘ডুমরা থিরতে’। এই উপন্যাস দুটির ক্ষেত্রে তখন অবশ্য তিনি বাংলা ভাষাই ব্যবহার করেছেন। বর্তমানে টোটো ভাষাভাষির মানুষের সংখ্যা ১৬৩২ জন। এই গোটা জনজাতির প্রতিনিধি ৫৯ বছর বয়সী ধনীরাম টোটো নিজের মাতৃভাষা ও সংস্কৃতিকে বাঁচাতে প্রায় ২৫ বছর ধরে লড়াই করে চলেছে। টোটোপাড়ার লোকসংস্কৃতি, গান, বনপাহাড়, টোটো দের জমিহারানোর ইতিহাস ধনীরাম তাঁর নানা লেখায় তুলে ধরেন , স্বপ্ন দেখেন টোটো দের বাঁচিয়ে রাখার। পুরস্কার কখনও শেষ কথা হতে পারেনা আর কোনো পুরস্কার দিয়ে হয়তো এই লড়াইকে মাপাও যায়না।
Discussion about this post