কলকাতার দুর্গোৎসব ও শহরের ঐতিহ্যবাহী ইতিহাস যেন একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। রাজধানীর বুকে বারোয়ারি পুজোর প্রচলনের আগে শহরবাসীর নজর কাড়ত কেবল বনেদী বাড়ির দুর্গাপূজাই। এক এক বাড়ির ছিল এক এক রকম নিয়ম! কোথাও আলাদা ছিল পুজোর প্রচলিত নিয়ম, তো কোথাও বৈচিত্র্য দেখা যেত ভোগে। বহু বছর ধরে এমনই এক বৈচিত্র্যময় দুর্গোৎসবের সাক্ষী বাগবাজারের হালদার বাড়ি।
হালদার পরিবারের আদি নিবাস ছিল চন্দননগরের নোয়াপাড়া অঞ্চলে। পরবর্তীতে স্বর্গীয় কৃষ্ণপদ হালদার কলকাতায় এসে জমি-বাড়ির ব্যবসা শুরু করে বিত্তশালী হয়ে জানবাজার অঞ্চলে বাড়ি তৈরি করেন। পরে আর্থিক সংকটের কারণে জানবাজারের বাড়িটি বিক্রি করে বাগবাজার অঞ্চলের এই বাড়িতে চলে আসেন তাঁর পরিবার। এই হালদার বাড়িতে সপরিবারের বদলে বছর-বছর একাই আসেন মা। দেবীমূর্তি এখানে কষ্টিপাথরের। কথিত আছে, পরিবারের কোনও এক সদস্য একসময় ওড়িশার বালেশ্বরের সাহেবপুর অঞ্চলে ভ্রমণে গিয়েছিলেন। সেখানেই তিনি স্বপ্নাদেশ পান, স্থানীয় এক ধীবরের বাড়িতে মাটির ১৪ ফুট গভীরে রয়েছেন দেবী। এরপরই মাটি খনন করে উদ্ধার হয় তিন ফুটের এই কষ্টিপাথরের মূর্তি। বাসাবদলের পর কষ্টি পাথরের মূর্তিটি নতুন করে প্রতিষ্ঠা করে নিত্য পুজো আরম্ভ হয়।
আরও পড়ুন যুগ পাল্টালেও সাবেকিয়ানায় আজও উজ্জ্বল বিডন স্ট্রিটের মিত্র বাড়ির পুজো!
প্রাচীন এই মূর্তিতে মায়ের দু’পাশে একটু নীচের দিকে রয়েছেন তাঁর দুই সখী জয়া ও বিজয়া। মাথার উপরে বিরাজমান মহাকাল। সালঙ্কারা দুর্গা পদ্মের ওপর আসীন। প্রায় সাড়ে চারশো বছর ধরে এই মূর্তিই গৃহদেবতা হিসাবে পূজিত হয়ে আসছেন এখানে। সারা বছর দেবীকে পূর্ব মূখী করে পুজো করা হলেও দুর্গা পুজোর সময় দেবী থাকেন দক্ষিণ মুখী। কারণ পরিবারের সদস্যদের বিশ্বাস, কৈলাশ থেকে দেবী দক্ষিণ মুখেই মর্ত্যে আসেন। পুজোয় হালদার বাড়ির মহিলারা দূর্গাষষ্ঠী পালন করেন না। এই দিন তাঁরা মাছ খেয়ে, মুখে পান নিয়ে ঠাকুরদালানে আসেন। সপ্তমীর দিন দু’টি বিরাট ছাতায় হালদার বাড়ির নবপত্রিকার সাথেই আরও এক জ্ঞাতি বাড়ির নবপত্রিকা গঙ্গায় যায়। বনেদী বাড়ি হলেও, বাড়ির মেয়েদের গঙ্গার ঘাটে যাওয়ার ক্ষেত্রে কোনোকালেই কোনও বিধি নিষেধ নেই। চমক রয়েছে মায়ের বিসর্জনেও। এখানে প্রতিমার বদলে প্রতীকী ঢাক বিসর্জন দেওয়া হয় দশমীতে। ভাবলে অবাক লাগে, এত বছরের এই পুজো আধুনিকতার ছোঁয়ায় তার ঐতিহ্য হারায়নি এতটুকুও। আজকের দিনে সেরার শিরোপার দৌড়ে থাকা ‘সবচেয়ে বড় দুর্গা’দের পাশাপাশি হালদার বাড়ির ৩ ফুটের এই দুর্গাও পূজিত হন স্বমহিমায়!
Discussion about this post