আজ থেকে প্রায় চারশো বছর আগের কথা। এই রাস্তা দিয়েই ভারতের সাথে তিব্বত, চীন, ভুটান ও মঙ্গোলিয়ার বাণিজ্য চলতো। ১৫৭ বছর আগে দ্বিতীয় ইন্দো-ভূটান যুদ্ধে হয়তো শেষবার ভুটানের সৈন্যরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এসেছিল এই পথ দিয়েই। তারপর থেকে এই অতি প্রাচীন বাণিজ্যপথটি তার জৌলুস হারাতেই থাকে। এই বাণিজ্যপথ নিয়ে স্থানীয় গ্রামবাসীদের মধ্যে শতাধিক পৌরাণিক গল্প কথা প্রচলন আছে। একসময় এই পথে ঘোড়া নিয়ে বাণিজ্য করতে যেত বণিকরা।
কথিত আছে এক সওদাগর ভারত থেকে ঘোড়ার ওপর মালপত্র বোঝাই করে নিয়ে যাচ্ছিলেন তিব্বতে। কিছুটা যাওয়ার পর ঘোড়ার শিরদাঁড়া ভেঙে যায়। সওদাগর সেখানে ঘোড়াটিকে ছেড়ে দিয়েই চলে যান। ঘোড়াটি না খেতে পেয়ে মারা যায়। ওখানেই ঘোড়াটি অভুক্ত থেকে পাথর হয়ে যায়।’ স্থানীয় নেপালি, ডুকপা লোকেদের কাছে এই জায়গাটি বড় পবিত্র স্থান ‘Ghora-Dunga’ (নেপালিতে Dunga মানে হলো পাথর) বা ‘Tacha-Gacha’ (জনখা/ডুকপা ভাষায় Tacha- ঘোড়া, Gacha- পাথর) নামেই পরিচিত। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে একটা নির্দিষ্ট পাথরের উপর আজও ঘাস চাপিয়ে প্রণাম করে ফেরেন গ্রামের মানুষেরা। এই ঘন ভুটান লাগোয়া জঙ্গলের দুর্গম রাস্তায় যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না মানুষের। কিন্তু বক্সা-দুয়ারের ১৩টি গ্রামের জলের যোগান আসে এই পাহাড়ের জটা থেকে। কোনো কোনো সময় জলের পাইপ খারাপ হলেই একমাত্র লোকজন সেখানে যায় মেরামত করতে। এছাড়া ওদিকে কেউ যায় না। এই ঐতিহাসিক রাস্তাটি সাপের মতো ঘন জঙ্গল ভেদ করে ভারতের ভেতরে প্রায় ১৪-১৫ কিলোমিটার বিস্তৃত। যে পথ দিয়ে যেতে গিয়ে দেখা যেতে পারে হিমালয়ান ভাল্লুক, ঘোড়াল, জংলি শুকর, আরও কত কী! বছরের শেষে কোনো কোনো গ্রামবাসী পরিবার নিয়ে ট্রেকে যায় সিনচুলা রোড বেয়ে উঠে এখানের সর্বোচ্চ উঁচু ন্যাড়া পাহাড়ের শৃঙ্গে যা ‘পামসে টপ’ বলে পরিচিত।
কালের নিয়মে আজ এই রাস্তায় পুরু পলি (জঙ্গলের পাতার হিউমাস থেকে) পড়েছে। রাস্তার ওপর বটবৃক্ষের মতো বিভিন্ন প্রজাতির গাছ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, পাথরের ওপর জমেছে শ্যাওলা। এটি পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় একটি ট্রেক রুট যা সিনচুলা হিল রোড নামে পরিচিত। এই রাস্তায় বড় সমস্যা ছিল জলের। সে বহু বছর আগের কথা, টাট্টু ঘোড়ায় চেপে পারিষদদের নিয়ে রাজা ফিরছিলেন সিনচুলা রোড দিয়ে। আসে পাশে কোনো জল না পাওয়ায় গুপী বাঘার গান শুনে ভূতের রাজার আবির্ভাবের মতো আবির্ভাব হন এক তিব্বতি সন্ন্যাসী। মন্ত্রের সাহায্যে পাহাড় থেকে সৃষ্টি করেন এক ছোট্ট ঝর্ণা। রাজা ও পরিষদগণ তৃষ্ণা মেটান। তারপর থেকে জায়গাটার নাম হয় ওম-চু-পানি (নেপালিতে ওম কথার অর্থ ‘ঈশ্বরের দূত’)। আজও ওই ঝর্ণা থেকে ট্রেকার হোক বা গ্রামের মানুষ, সবাই তৃষ্ণা মেটায়।
নিগূঢ় এই পথ দিয়ে যেতেই বড় উষ্মার উদ্রেক হয়। বুকে হাপরের ধ্বনি আর তারুণ্যের দুঃসহ স্পর্ধা নিয়ে কতবার যে উঠেছি তার কোনো গুনতি নেই। পথে চোখ ঝলসানো বাহাড়ি অর্কিডের ঝাঁক। বাঁশগাছে প্যারোটবিলের কিচির মিচির, হর্নবিল উড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখতে দেখতে কোথা থেকে হঠাৎ করে মেঘ এসে অন্তর আত্মাকে দুলিয়ে দিয়ে যাবে আপনি বুঝতেও পারবেন না। এই ঐতিহাসিক রাস্তাকে বনদপ্তর থেকে প্রকাশিত ‘ট্রেক রুটস অফ নর্থ বেঙ্গল’ বইয়েও উল্লেখ করা হয়েছে।
Discussion about this post