‘বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান’- এই বাক্যটিকেই আপ্তবাক্য হিসেবে আমাদের দেশ বহন করে নিয়ে চলেছে ঐতিহ্য। শুধু দেশ নয়, দেশের মধ্যে আমাদের এই ছোট্ট বাংলা যেন এক খন্ড নীল আকাশের মত সেই ঐতিহ্যকে মনে করিয়ে রাখে। প্রাচীনকাল থেকেই সেই মুক্ত চিন্তা, মানুষের প্রতি মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভালোবাসা প্রকাশের ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত হয়ে রয়েছে বাংলা। বর্তমানে দেশজুড়ে অসংখ্য হিংসা বা হানাহানির ঘটনা ঘটে চলেছে, বাংলাতেও যে সেই হিংস্রতা নেই তা নয়। কিন্তু তবু সেসবের পাশাপাশি, সম্প্রীতির ছবিগুলিই যেন মানুষকে তপ্ত দুপুরে ঠাণ্ডা বাতাসের মত শীতল করে দেয়।
প্রাচীনকাল থেকেই বাংলায় হিন্দু-মুসলিম মেলবন্ধনের ঐতিহ্য চোখে পড়ার মত। বাংলার মনিষীরা, স্বাধীনতা সংগ্রামীরা সকলেই সেই ঐতিহ্যকেই বারবার রক্ষা করতে চেয়েছেন, মান্যতা দিয়েছেন। ফলে আজও দুর্গা পুজো থেকে ঈদ কিংবা কালীপুজো সবেতেই সেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায়। সেই নিদর্শনগুলি বর্তমানে বাংলার সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে উঠেছে। সেই ঐতিহ্যকেই বহন করে নিয়ে চলেছে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার, তপন ব্লকের মনহোলি গ্রামের হাটখোলার জোড়া কালীপুজো।
মনহোলি গ্রামের জোড়া কালীপুজোটি গ্রামের মানুষের কথা মত প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো। পাশাপাশি রয়েছে দুটি কালী মন্দির, এবং সেই মন্দিরদুটির পাশে রয়েছে একটি পীরবাবার মাজার। দুটি মন্দিরের মধ্যে একটি শ্যামার মন্দির এবং অন্যটি নির্দয়া কালীর মন্দির। প্রতিবছর জাঁকজমকের সঙ্গে এই গ্রামের দুটি মন্দিরে কালী পুজো হয়ে থাকে। তবে মজার ব্যাপার হল, পুজো শুরু হয় দরগায় কোরান পাঠ শেষ হওয়ার পর। পুজোর শেষে যখন বলি হয়, সেই সময়েই দরগাতেও সিন্নি চড়ানো হয়। গ্রামের মানুষের কথা মত বহুকাল ধরেই এইভাবেই সামঞ্জস্য বজায় রেখে পুজো হয়ে আসছে প্রাচীনকাল থেকে।
সিন্নি উৎসর্গ করা থেকে শুরু করে কোরান পাঠ সমস্ত কর্মসূচীর সম্পূর্ণ খরচ বহন করে জোড়া কালীমাতা পুজো কমিটি। শোনা যায়, একসময় মনহোলি গ্রামের জমিদার বাড়ি শুরু করেছিল এই মন্দির ও দরগায় সামঞ্জস্য বজায় রেখে পুজোর নিয়ম। দিনকালের পরিবর্তন হলেও, সেই সুপ্রাচীন নিয়ম আজও বংশপরম্পরায় মেনে চলেন গ্রামের মানুষ ও পুজো কমিটি। জমিদারি প্রথা শেষ হওয়ার পর বংশধরদের বদলে পুজোর দায়িত্ব নিয়েছে কমিটি। পরিবর্তন এটুকুই। গ্রামের মানুষই কমিটি গঠন করে কাঁধে তুলে নিয়েছে পুজোর সমস্ত দায়িত্ব। এই নিয়ে গ্রামের মানুষেরাও গর্বিত। আগামীকালেও এই ধারা এভাবেই বজায় থাকবে বলেই তাঁরা আশাবাদী।
Discussion about this post