“কে কতটা বুঝলে জানিনে, কিন্তু যিনি পড়েছিলেন, তাঁর সঙ্গে আমার চোখেও জল এল।’’- কথাগুলি আর কেউ নয়, কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের। ভাগলপুরে বসবাসকালে, এক আত্মীয়ের কন্ঠে রবীন্দ্রনাথের ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ নাটকটি শুনতে শুনতে বালক শরৎচন্দ্রের চোখে জল এসেছিল। এভাবেই তিনি প্রথম পরিচিত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের ভাবনার সঙ্গে, সেই প্রথম পরিচয়েই প্রকাশ করেছিলেন অশেষ মুগ্ধতা। কিন্তু, রবীন্দ্রনাথের লেখা শুনে যে মুগ্ধ বালকটির চোখ আবেগের জলে ভেসেছিল, সেই মানুষটির সঙ্গেই রবীন্দ্রনাথের নাকি ছিল বিবাদ!
শরৎচন্দ্রের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের লেখার পরিচয় বালক বয়সে হলেও, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে শরৎচন্দ্রের লেখার পরিচয়টি ভীষণ মজার। শরৎচন্দ্রের এক বন্ধু শরৎচন্দ্রের অনুমতি ছাড়াই নামবিহীনভাবে ভারতী পত্রিকায় ‘বড়দিদি’ গল্পটি কয়েকটি কিস্তিতে ছাপিয়ে ফেলেছিলেন। সেইসময় ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার সহসম্পাদক এসে সটান রবীন্দ্রনাথের কাছে অনুযোগ করেছিলেন এই বলে যে, রবীন্দ্রনাথ কেন বঙ্গদর্শনে গল্প না দিয়ে, ভারতীকে তাঁর গল্প দিয়েছেন। অবাক রবীন্দ্রনাথ গল্পটি পড়ে বলেছিলেন, “আমার লেখা নয়, তবে খুব শক্তিশালী কোন লেখকের লেখা।”
এভাবেই একে অপরের লেখার সঙ্গে পরিচিতি এবং পরস্পর মুগ্ধতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশের পরেও দুজনের বিবাদ তৈরি হল কেমন করে! শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৬ সালে। তিনি তখন সক্রিয়ভাবে স্বদেশী আন্দোলনে জড়িত। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই ব্রিটিশ সরকার নিষিদ্ধ করেছিল বইটি। শরৎচন্দ্র বইটি রবীন্দ্রনাথের কাছে পাঠান প্রতিক্রিয়ার জন্য। তিনি আশা করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় ব্রিটিশরা দমে যাবে এবং স্বদেশী আন্দোলনেও এর প্রভাব পরবেনা। কিন্তু, হলো তার উলটো। রবীন্দ্রনাথ বই পড়ে রীতিমত সমালোচনা করে চিঠি লিখলেন। এতে শরৎচন্দ্র অত্যন্ত কষ্ট পেয়েছিলেন এবং হতাশ হয়েছিলেন। তিনি নিজেও রবীন্দ্রনাথকে অভিমানভরা একটি চিঠি লিখেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “শক্তিকে আঘাত করলে তার প্রতিঘাত সইবার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এই কারণেই সেই আঘাতের মূল্য— আঘাতের গুরুত্ব নিয়ে বিলাপ করলে সেই আঘাতের মূল্য একেবারেই মাটি করে দেওয়া হয়।’’ শরৎচন্দ্র এর উত্তরে লিখেছিলেন, “মোটা ভাতের বদলে যদি Jail Authority ঘাসের ব্যবস্থা করে, তখন হয়ত তাদের লাঠির চোটে তা চিবোতে পারি, কিন্তু ঘাসের ড্যালা কণ্ঠরোধ না করা পর্যন্ত অন্যায় বলে প্রতিবাদ করাও আমি কর্তব্য বলে মনে করি।’’ শেষ পর্যন্ত অবশ্য ক্ষোভ উগরে দেওয়া সেই চিঠি শরৎচন্দ্র রবীন্দ্রনাথকে পাঠাননি। বিভিন্ন বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির তফাৎ ছিল। ১৯২১ সালে শিক্ষা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে শরৎচন্দ্রের বিতর্ক হয়েছিলো। তবে এই অভিমান মিটে গিয়েছিল পরবর্তীকালে।
Discussion about this post