একটি ভুল সিদ্ধান্ত, একটি চিরকালীন শিক্ষা – আকাশে উড়তে শেখা মানুষের এক অনন্য অর্জন হলেও, মাঝে মাঝে একটি সামান্য ভুলে সেই আকাশই হয়ে ওঠে মৃত্যুকূপ। ১৯৯৪ সালের ২৩ মার্চ ঘটে যায় এমনই এক হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনা – অ্যারোফ্লট ফ্লাইট ৫৯৩ বিধ্বস্ত হয়ে মৃত্যু হয় ৭৫ জনের। মস্কোর শেরেমেতিয়েভো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে হংকংয়ের কাই টাক এয়ারপোর্টের পথে উড্ডয়ন করে অ্যারোফ্লট ফ্লাইট ৫৯৩। প্রযুক্তির আধুনিকতায় ভরপুর একটি এয়ারবাস এ৩১০ বিমান, দক্ষ রুশ পাইলট, আন্তর্জাতিক রুট – সবই ছিল নিখুঁত। তবুও কেন এই বিপর্যয়? কারণ একটি নিষিদ্ধ কাজ – পাইলট তার দুই সন্তানকে বিনোদনের উদ্দেশ্যে ককপিটে এনেছিলেন। আর সেখান থেকেই শুরু হয় বিভীষিকা।
বিমানটি যখন অটোপাইলটে ছিল, তখন ক্যাপ্টেন ইয়ারোস্লাভ কুদ্রিনস্কি তার ছেলে এলদার ও মেয়ে ইয়ানাকে বসান পাইলটের আসনে। মেয়ে কিছু সময় কাটিয়ে চলে যাওয়ার পর ছেলেটি কৌতূহলবশত কন্ট্রোল স্টিকে হালকা চাপ দেয়। এতে অটোপাইলটের একটি অংশ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে এবং বিমান ডানদিকে হেলে যায়। রুশ পাইলটেরা যেহেতু পশ্চিমা প্রযুক্তির সফটওয়্যার-ভিত্তিক নীরব সংকেতে অভ্যস্ত ছিলেন না, তাই তারা বিপদের লক্ষণ বুঝতে পারেননি। বিমান দ্রুত ভারসাম্য হারায়, স্টলে পড়ে যায়, এরপর তার ওপর নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি হারিয়ে ফেলে।
পাইলট ও কো-পাইলট তখন মরিয়া হয়ে নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করেন। একবার বিমান কিছুটা সোজা হয়, কিন্তু ওভারকারেকশনের ফলে আবারও স্টল ও স্পিনে ঢুকে পড়ে। শেষ মুহূর্তে খানিকটা ভারসাম্য ফিরলেও আর সময় ছিল না। ঘণ্টায় প্রায় ২৫০ কিমি গতিতে বিমানটি সাইবেরিয়ার এক পর্বতের বুকে আছড়ে পড়ে – তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয় সবার। তদন্তে দেখা যায়, কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল না – সবটাই মানবিক ভুল ও নিয়ম ভাঙার ফল।
প্রথমদিকে অ্যারোফ্লট বিষয়টি ধামাচাপা দিতে চাইলেও, পরে ককপিট রেকর্ডার প্রকাশ্যে এলে আসল সত্য সামনে আসে। এরপরে বদলে যায় আন্তর্জাতিক উড্ডয়ন নীতি – শিশুদের ককপিটে প্রবেশে কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়, পাইলটদের ‘ক্রু রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট’ প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক হয়। এই দুর্ঘটনা এটাই শেখায় – প্রযুক্তি যত উন্নতই হোক না কেন, একটিমাত্র দায়িত্বজ্ঞানহীন সিদ্ধান্ত মুহূর্তে ৭৫টি প্রাণ কেড়ে নিতে পারে। ফ্লাইট ৫৯৩ আজও একটি চরম সতর্কবার্তা।
চিত্র ঋণ – Tubelight Media
Discussion about this post