একবিংশ শতাব্দী মানেই আধুনিকতা। সময়ের সাথে ধীরে ধীরে বদলেছে মানুষের জীবনযাত্রার মান। তবে বর্তমানের উন্নত সমাজ পরিণত হয়েছে অর্থ নির্ভর ব্যাবস্থায়। শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্য, মানুষের জীবনযাপনের মানের নির্ধারক হয়ে উঠেছে অর্থ। নামী দামী স্কুলের মোটা অঙ্কের মাইনে বনাম সরকারি স্কুলের স্বল্পমূল্যের শিক্ষা যেন সমাজের বিভেদের কারণ হয়ে উঠেছে। তবে আজকের ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’ শিক্ষা ব্যবস্থার মাঝেও উজ্জ্বল ব্যাতিক্রম বসিরহাট হাইস্কুলের পদার্থবিদ্যার প্রাক্তন শিক্ষক সুভাষ কুন্ডু। কমপক্ষে ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে গৃহশিক্ষকতা করেছেন তিনি। তবে কখনও ছাত্র-ছাত্রীদের থেকে একটি পয়সা পারিশ্রমিক নেননি৷
ভারতের স্বাধীনতার বছরে বসিরহাটে জন্মগ্রহণ করেন এই মহান শিক্ষক। সুভাষ কুন্ডু পড়াশোনা করেছেন এই বসিরহাট হাই স্কুলেই৷ তারপর তিনি বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে পদার্থবিদ্যায় স্নাতক ও রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে এম.এস.সি পাশ করেন৷ ১৯৬৮ সালে তিনি বসিরহাট কলেজে পদার্থবিদ্যার শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হন। ১৯৭১ সালে রাজনৈতিক আন্দোলনে জড়িত থাকার অপরাধে গ্রেফতার হন সুভাষ কুন্ডু। তার ওপর চলে শারীরিক নির্যাতন। তবে তিনি বেশিদিন তার ভালোবাসার শিক্ষা জগৎ থেকে দূরে থাকতে পারেননি। কারাজীবন শেষের পর আবার তিনি ফিরেছিলেন শিক্ষকতার জীবনে৷
কিছুদিন পর তিনি বসিরহাট হাই স্কুলে পদার্থ বিদ্যার শিক্ষক হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন৷ কখনও তিনি গুরুতর অসুস্থ হলেও, বন্ধ হত না তার অবৈতনিক পাঠাগার। শারীরিক অসুস্থতাকে তোয়াক্কা না করেই, দিনের ১২-১৪ ঘণ্টা কেটে যেত ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে৷ তবে কোনও পড়ুয়া তার কাছে টিউশানি পড়তে চাইলে তিনি প্রথমেই পড়ুয়ার মার্কশিটের অঙ্কের নম্বর দেখতে চাইতেন৷ নম্বর দেখে তিনি সন্তুষ্ট হলে তবেই মিলত তাঁর কাছে পড়ার অনুমতি৷ বর্তমানে বিভিন্ন উচ্চ পদে কর্মরত তার বহু ছাত্র-ছাত্রী।
বিজ্ঞানের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাকটিক্যালে সুবিধার জন্য নিজ খরচে বসিরহাট শহরের বুকে তিনি গড়ে তুলেছিলেন আধুনিক ল্যাব ‘ইনিস্টিটিউট অফ ফিজিক্স’। সেখানে বিনা পয়সায় প্র্যাক্টিক্যালের সুবিধা পান বসিরহাট সহ দুই চব্বিশ পরগনার বিজ্ঞানের অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী৷ শিক্ষাক্ষেত্রে তার এই মহান অবদানের পরও সরকারি অনুষ্ঠানে তিনি একপ্রকার ব্রাত্য থেকেছেন তিনি। তবে এইসব নিয়ে না ভেবে, তিনি বলতেন যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনের দিশা দেখানোর পথ দেখিয়ে যাবেন৷ ২০০৭ সালে চাকরি থেকে অবসর নিলেও চলতে থাকে তার অবৈতনিক পাঠাগার। ৭মে ২০২১ মারা যান সুভাষ কুন্ডু। তার চলে যাওয়া ছাত্র ছাত্রীদের পাশাপাশি সমস্ত বিজ্ঞানপ্রেমীদের কাছে এক অপূরণীয় ক্ষতি।
সুভাষ কুন্ডুর এক প্রাক্তন ছাত্র তার প্রিয় স্যার সম্পর্কে বলেছেন – “তিনি ছিলেন অত্যন্ত দায়িত্ববান শিক্ষক৷ সব সময় তিনি চেয়েছেন ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে নিজের জ্ঞান উজাড় করে দিতে৷ স্যারকে নিয়ে মজার এক ঘটনার প্রসঙ্গ তিনি জানান- “একদিন স্যারের টিউশানি পড়ানোর কথা বিকেল ৪টের সময়৷ অনিবার্য কারণবশত: স্যার সেই সময় পৌঁছতে পারেন নি৷ এদিকে সাড়ে চারটে বেজে গেলে,পড়ুয়ারা ভাবলেন আজ বোধহয় স্যার পড়াবেন না৷ তারা মহানন্দে পাশের ফাল্গুনি সিনেমা হলে ঢুকেছেন৷ এদিকে স্যার এসে দেখলেন ছাত্র-ছাত্রীরা বেপাত্তা৷ তিনি সটান সিনেমা হলে গিয়ে সেই ছাত্র-ছাত্রীদের বের করে এনে আবার পড়াতে বসিয়েছেন।”
চিত্র এবং তথ্য ঋণ – ভালোবাসি বাংলা
Discussion about this post