পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম প্রসিদ্ধ শহর হাওড়া। হুগলি নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত হাওড়া পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার যমজ শহর। রবীন্দ্র সেতু, বিদ্যাসাগর সেতু, বিবেকানন্দ সেতু ও নিবেদিতা সেতু নামে চারটি সেতু হাওড়া ও কলকাতা শহর দুটিকে যুক্ত করছে। এছাড়া দুই শহরের মধ্যে জলপথেও ফেরি পরিষেবা চালু আছে। তবে হাওড়ার ‘হাওড়া’ হয়ে ওঠার পিছনের ইতিহাস জানেন কি? হাওড়া জেলার নামকরণের পিছনে কোন নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক প্রামাণ্য নথি না থাকলেও নানান যুক্তি ও জনশ্রুতির সংমিশ্রণে তৈরি হয়েছে বেশ কিছু আনুমানিক ধারণা।
‘হাবরা’ থেকে হাওড়া নামের উৎপত্তি হয়ে থাকতে পারে বলে মনে করে থাকেন অনেকে।এক প্রচলিত জনশ্রুতি অনুযায়ী এক গরীব বৃদ্ধা বোঝা মাথায় যাওয়ার সময় এক সাহেব ইংরেজীতে স্থানটির নাম জিজ্ঞাসা করলে সেই বৃদ্ধা ভাষা বুঝতে না পেরে নিরুত্তর থাকলে সেই সাহেব বৃদ্ধার গা ছুঁয়ে আবার জায়গাটির নাম জিজ্ঞাসা করলে বৃদ্ধা ‘হা- বরা’ বলে রাগে বোঝাটি ছুঁড়ে ফেলেন। সেই ইউরোপীয় ভাবলেন স্থানটির নাম বোধ হয় ‘হা বরা’। সেখান থেকেই কালক্রমে হাওড়া শব্দটি এসেছে এমন মতও কিন্তু প্রচলিত। আবার অন্য একটি সূত্র মতে বাংলা ‘ হাবোড়’ থেকে ‘হাওড়া’ নামের উৎপত্তি হয়ে থাকতে পারে। হাবোড় শব্দের অর্থ জলা বা কাদাময়মাটি। এই হাওড়া জেলা জুড়ে প্রচুর খানা খন্দ, গর্ত থাকার দরুন জেলাটি ‘হাবোড়’ থেকে পরবর্তীকালে ‘হাওড়ায় পরিণত হয়েছে।
একথা মনে করা হয়ে থাকে হাড়িয়াড়া শব্দ থেকেও হাওড়া নামের উৎপত্তি ঘটতে পারে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বেঙ্গল কাউন্সিল দিল্লীর বাদশা ফারুখ শিয়রের থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীতে গঙ্গার পশ্চিম তীরে পাঁচটি গ্রামের মৌজার পত্তনী লাভ করেছিল। সেগুলি হল শালিখা, হাড়িয়ারা, কাসুন্দিয়া, রামকৃষ্ণপুর ও বেতড়। এই হাড়িয়াড়া থেকেই হাওড়া এসেছে বলে মনে করা হয়। বরেণ্য ভাষাবিদ ডঃ অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় ‘আড়া’ শব্দের অর্থ জলাশয়ের উঁচু পাড়-এমনটা দেখিয়েছেন। এখন এমনটা মনে করা হয়ে থাকে হাঁড়ি সম্প্রদায়ের মানুষরা কোন জলাশয়ের উচুঁ পাড়ে বসতি করেছিল বলেই জায়গাটির নাম হয়েছে হাঁড়িয়ারা। তিনি এটিকে দেশীয় শব্দ বলেও অভিহিত করেছেন। পূর্ব ভারতে কাদা অর্থ বোঝাতে হাবোড় শব্দের প্রয়োগ আছে। যেমন যে ঘাটে বালি বেশি, তাকে বেলেঘাটা বলে। তেমনি পাঁক বা কাদা বেশি থাকলে ‘হাবড়ে’ ঘাট বলে।
‘হাওড়া’ কথাটির শেষের ‘ড়া’ শব্দটি দ্রাবিড় ভাষার চিহ্ন, যে ভাষায় ‘হাওড়’ শব্দের অর্থ জলা জায়গা। একটা সময়ে হাওড়া জেলার একাংশ দলিল দস্তাবেজে ‘পরগণা বোরো’ বলে উল্লিখিত হত।এই বোরো শব্দের অর্থ- জলমগ্ন জায়গা। এ বিষয়ে একটি কথা মনে করে থাকেন অনেকেই। বাংলায় আর্য বসতি বিস্তারের আগে যে আদিম অধিবাসীরা বসতি স্থাপন করেছিল, তার মধ্যে দ্রাবিড় জাতিই হয়তো এ অঞ্চলে ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। এছাড়া অসংখ্য খাল, বিল, ডোবা ও জলা জায়গার অস্তিত্ব থাকার দরুন এই এলাকাটির নাম হাওড়া হয়ে থাকতে পারে। পূর্ব বঙ্গীয় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল এই হাওড়া।
Discussion about this post