বীরভুম-ঝাড়খন্ড সীমানায় তুম্বুনি গ্রামের স্কুল শ্রীরামকৃষ্ণ শিক্ষাপীঠ। স্কুলের হস্টেলের সামনে বিস্তীর্ণ মাঠ। শোনা যায় সাংবাদিক জ্যোতির্ময় দত্তের কাছে এই জায়গার গল্প শুনে এসে হাজির হয়েছিলেন তারাপদ রায়, গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়সহ আরো অনেকে। তাঁদের মতে নাকি কাশ্মীর নয়, তুম্বুনি গ্রামটিই আসল ভূস্বর্গ। পরবর্তীকালে এই মাঠের সামনে বসেই দিনের পর দিন গল্প করে গেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের মত ব্যক্তিত্বরা। গাছতলায় বসে উদাত্ত কন্ঠে গান গেয়েছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়।
ষাটের দশকে মা সারদার সাক্ষাৎ শিষ্য মুকুন্দবিহারী সাহা গড়ে তুলেছিলেন এই স্কুল। তাঁরই উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল রামকৃষ্ণ মিশনের আদর্শে অতিথি নিবাস, ধ্যান কক্ষ, হোস্টেল, বাগান প্রভৃতি। শোনা যায় সারদা মা নাকি মুকুন্দবিহারীকে বলেছিলেন, “সন্ন্যাসী কেন হবি, তুই সমাজসেবা কর।” এরপরই মুকুন্দবিহারী সাহা রামপুরহাটে আসেন শিক্ষকের চাকরি নিয়ে। রামপুরহাট শহরে কলেজ, স্কুল প্রভৃতির বিকাশে সিংহভাগ অবদান তাঁর। ছাত্রদের ‘আমার ছেলে’ বলে সম্বোধন করতেন। শহরে প্রধান শিক্ষকের চাকরি ছেড়ে তিনি চলে এলেন আদিবাসী অঞ্চলে। স্কুল প্রতিষ্ঠার মূল কারণটিই ছিল সাঁওতাল পরগণার বাচ্চাদের শিক্ষাদান। শিক্ষাপীঠের নামডাকের জন্য রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মেধাবী ছাত্রেরা আসতেন এখানে। মুকুন্দবিহারী বড়ো থেকে ছোট সকলের মধ্যে পরিচিত ছিলেন ‘দাদু’ নামে। তাঁর মৃত্যুর পরেও বছরের পর বছর অনুষ্ঠান করে তাঁর জন্মদিন পালন করা হত। পালন করতেন স্কুলের শিক্ষকরা, প্রাক্তন ছাত্ররা এবং তাঁরই প্রতিষ্ঠিত ‘সোসাইটি’ সদস্যরা। এই সোসাইটি তৈরি হয়েছিল স্কুল পরিচালনা ও স্কুলের সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য।
ফলত, সৌন্দর্য ও শিক্ষা উভয় দিক থেকেই ঐতিহ্যপূর্ণ এই তুম্বুনি গ্রাম ও শ্রীরামকৃষ্ণ শিক্ষাপীঠ। বর্তমানে এই স্কুল রাজনৈতিক মদতপুষ্ট স্থানীয় দুষ্কৃতিদের কবলে। স্কুল ক্যাম্পাস থেকে বেআইনিভাবে কেটে ফেলে বিক্রি করা হচ্ছে গাছ, ‘দাদু’র জন্য তৈরি স্মৃতিভবনে মদ্যপান ও অন্যান্য অসামাজিক কাজকর্ম, মদ্যপ অবস্থায় মারধোর, হুমকি দেওয়া চলছে। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে পুলিশের দ্বারস্থ স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীরা এবং সোসাইটি। পাশে দাঁড়িয়েছেন কিছু স্থানীয় আদিবাসী। সকলেই চান স্কুলে পুরনো ঐতিহ্য ফিরে আসুক।
স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রী এবং ‘সোসাইটি’র সেক্রেটারি দেবিকা চট্টোপাধ্যায় বলছেন, “আমি এই স্কুলের ছাত্রী, আমার বাবা এই স্কুলেরই শিক্ষক ছিলেন। বাবার মত আরো অনেকেই স্কুলের জন্য জীবন সঁপে দিয়েছেন। সেই স্কুলের এই অবস্থা দেখতে পারছি না। স্কুলকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের কথা ভেবেছি”। স্কুলেরই একজন কর্মী জানাচ্ছেন, “আদিবাসীদের অধিকাংশই ছোটো বয়স থেকে নেশায় আক্রান্ত। তাদের পরিবারও সচেতন নয়। ফলে তাদের অনৈতিক কাজে বাধ্য করাও কঠিন কাজ নয়”। স্কুলের প্রধান শিক্ষক সন্দীপ সাহা জানিয়েছেন, ”কারা অসামাজিক কাজে জড়িত তা জানি না। তবে স্কুলের আগের অবস্থা ফিরে আসুক চাই। সবাইকে নিয়েই কাজ করতে চাই।”
Discussion about this post