বাগেরহাটের ঐতিহাসিক হযরত খানজাহান আলী (রহ.) এর মাজার সংলগ্ন ঠাকুর দিঘিতে যে মিঠা পানির কুমির যুগল ছিল, তারা কেবল প্রাণী ছিল না বরং প্রায় সপ্তম শতাব্দীর ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক ছিল । লোকবিশ্বাস অনুসারে, খানজাহান আলী তার শাসনামলে দিঘির পানি দূষণমুক্ত রাখতে সেখানে এক জোড়া মিঠা পানির কুমির ছেড়ে দেন । এই কুমির জোড়াকে তিনি ‘কালা পাহাড়’ (পুরুষ) এবং ‘ধলা পাহাড়’ (নারী) নামে ডাকতেন । সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তিনি নিজ হাতে তাদের খাবার খাওয়াতেন, যা মানুষ ও কুমিরের মধ্যে এক অস্বাভাবিক সখ্যতার জন্ম দেয়। এভাবে আধ্যাত্মিক আখ্যানের মাধ্যমে দিঘিতে এক পবিত্র প্রহরী উপস্থাপন করা হয়।
ধলা পাহাড় নামটি কোনো একক কুমিরকে বোঝাত না, বরং এটি ছিল একটি দীর্ঘ বংশপরম্পরার প্রতীক। প্রায় ছয়শ বছর ধরে বংশানুক্রমে স্ত্রী কুমিরকে এই নামে ডাকা হতো। ভক্তরা বিশ্বাস করতেন, ধলা পাহাড় বলে ডাক দিলে কুমিরটি ছুটে আসত এবং ভক্তদের মানত করা মুরগি খেয়ে তাদের মনস্কামনা পূরণ করত। মাজারকেন্দ্রিক সংস্কৃতিতে এই কুমির যুগল ভালোবাসা, আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতীকে পরিণত হয়। স্থানীয়দের মতে, এই কুমিরগুলো সাধারণত মানুষের ক্ষতি করত না। তবে, ভক্তদের দ্বারা অনিয়ন্ত্রিতভাবে সরবরাহ করা চর্বিযুক্ত খাবার এবং মাজার খাদেমদের অব্যবস্থাপনা কুমিরদের স্বাস্থ্যের জন্য দীর্ঘমেয়াদী ঝুঁকি তৈরি করে।
২০১৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ধলা পাহাড়-এর মৃত্যু বাগেরহাটের ঐতিহ্যে এক বড় আঘাত হানে । এটি ছিল খানজাহান আলী (রহ.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কুমিরের সাতশ বছরের আদি বংশের সর্বশেষ সদস্য। কুমিরটির বয়স হয়েছিল প্রায় ১০০ বছর। এর দৈর্ঘ্য ছিল ৯ ফুট এবং প্রস্থ ছিল ৬ ফুট। জেলা প্রশাসনের নির্দেশে এটির ময়নাতদন্ত করা হয়। মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণগুলির মধ্যে ছিল অবৈধ ফাঁস জালে জড়িয়ে যাওয়া, খাদ্যে বিষক্রিয়া অথবা অতিরিক্ত চর্বি জমে Pan Steatitis (প্যান স্ট্যাটিস) রোগে আক্রান্ত হওয়া। এই মৃত্যু আদি কুমির যুগলের ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটায়।
এই ঐতিহাসিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে প্রশাসনের উদ্যোগে ধলা পাহাড়-এর দেহাবশেষ সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কুমিরটির চামড়া, মাথা ও দাঁত ষাটগম্বুজ প্রত্নতত্ত্ব ও জাদুঘর বিভাগকে দেওয়া হয়। বর্তমানে ধলা পাহাড়ের চামড়া এবং কঙ্কাল জাদুঘরে প্রদর্শিত হচ্ছে, যা বাগেরহাটের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে দর্শকদের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে। আদি বংশের বিলুপ্তির পর, ঐতিহ্য রক্ষার জন্য মাদ্রাজ থেকে আনা কুমিরদের ক্ষেত্রেও অতিরিক্ত চর্বি, প্রজনন ব্যর্থতা এবং বাণিজ্যিক শোষণের মতো সমস্যা দেখা যায়। ধলা পাহাড়ের মৃত্যু একটি পবিত্র পরম্পরার পরিসমাপ্তি, যা আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ ও বাস্তুসংস্থানগত বাস্তবতার দ্বন্দ্বের ফল।
প্রচ্ছদ চিত্র ঋণ – bdnews24






































Discussion about this post