নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ, নবাব আলিবর্দি খাঁর শাসনকাল, পলাশির যুদ্ধ, নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার হার, বাংলায় ইংরেজ শাসনের ভিত্তি স্থাপনের সেই মুহূর্ত- এ সমস্ত বললেই যেন সরাসরি মনে পড়ে যায় নবাবী আমলে বাংলার রাজধানীর কথা। রাজধানীর ভূগোল বদলে গেলেও সেই শহরটি আজও দিব্যি থেকে গেছে। থেকে গেছে শহরের অতি গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস। শহরের নাম মুর্শিদাবাদ। নবাবী আমলের ইতিহাস থাকবে, আর নবাবের নবাবীর উপকরণ থাকবে না, তাই কি হয়?
তেমনই মনভোলানো উপকরণ ছিল হাতির দাঁতের নকশা করা বিভিন্ন সামগ্রী। নবাব ও অন্যান্য অভিজাতদের বাসগৃহ সাজানোর জন্যই মূলত হাতি শিকার করে, তার দাঁত উপড়ে ফেলে, তাই দিয়ে তৈরি হত নকশা করা সামগ্রী। আজ যদিও এই হাতির দাঁতের ব্যবসা বেআইনি। তৈরি হয়েছে এই হাতির দাঁতের লোভে অবৈধ চোরাশিকারিদের উৎপাত। নেওয়া হয়েছে অবৈধ পশুশিকার আটকাতে কড়া পদক্ষেপ। তবে, নবাবী আমলে এমনটা ছিল না মোটেই। হাতির দাঁতের শিল্পের রীতিমত ব্যবসা চলত বাংলায়। দেশি-বিদেশি বণিকদের কাছে এই শিল্পজাত দ্রব্যের চাহিদা ছিল অনেকখানি। ১৯৯২ সালের বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইন কর্মহীন করে তুলেছিল এই হস্তিদন্ত শিল্পীদের।
শিল্পকর্মে হাতির দাঁতের ব্যবহার অবশ্য খ্রিস্টজন্মের বহু আগে থেকেই প্রচলিত। প্রাচীন ভারতের সিন্ধু সভ্যতায় হাতির দাঁতের শিল্প বহুল প্রচলিত ছিল। বিহারের চম্পানগরে হাতির দাঁতের তৈরি নারীমূর্তি ও খেলনা পাওয়া গেছে। সাঁচীস্তূপের শিলালিপি থেকে জানা যায় খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে বিদিশায় হাতির দাঁতের শিল্পকর্মের ব্যবসা ছিল। খ্রিস্টীয় ১০ম শতাব্দীর কলিঙ্গ তাম্রলিপিতে হাতির দাঁতের উল্লেখ আছে। মোগল আমলে এই শিল্প সারা ভারতে বিশেষ সমাদর পেয়েছিল। এছাড়া, ব্রিটিশরা আফ্রিকা থেকে হাতির দাঁত আনিয়ে ভারতীয় কারিগরদের দিয়ে সামগ্রী বানিয়ে সেগুলি ইউরোপের বাজারে রপ্তানি করত। ভারতের জঙ্গল এবং রাজা-মহারাজাদের পোষা হাতি থেকেও হাতির দাঁত সংগৃহীত হতো।
১৭০৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত হলে ঢাকা থেকে হাতির দাঁতের নকশা ও সামগ্রী তৈরির শিল্পীরাও এপার বাংলায় চলে এসেছিলেন। নবাবের পৃষ্ঠপোষকতায় জিয়াগঞ্জ থেকেই এই শিল্পের প্রসার ঘটে। বাড়িতে বাড়িতেই সেই সময় হাতির দাঁতের সামগ্রী তৈরি হতো। পরবর্তীকালে বহরমপুর, কাশিমবাজারে ছড়িয়ে পড়ে হাতির দাঁতের কাজ। দিনে দিনে এর চাহিদা বাড়তে থাকায় বহরমপুরে একটি কারখানাও গড়ে উঠেছিল। অভিজাতদের বাড়িতে হাতির দাঁতের কারুকার্য সাজিয়ে রাখার চল ছিল। আড়ি, চিহ্নে, কলম, থাপি, গিরদি, চোরসে ইত্যাদি যন্ত্র দিয়ে নিপুণ হাতে হাতির দাঁতের উপর ফুটে উঠত কারুকাজ।
Discussion about this post