বিশ শতকের মাঝামাঝি, ষাটের দশকে ঘটে এক ভয়ঙ্কর ট্রেন ডাকাতি। মুহূর্তের মধ্যে আলোড়ন ফেলে দিয়ে এই ডাকাতি পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষের ভিত নড়িয়ে দিয়েছিল। এটা কোনো গল্প নয়। বরং বাস্তবে ঘটে যাওয়া লন্ডন গামী এক মেল ট্রেনে এক অবিশ্বাস্য ডাকাতি। রাতের অন্ধকারে নিমেষের মধ্যে প্রায় ২৩ লক্ষ পাউন্ড টাকা নিয়ে চম্পট দিয়েছিল মাত্র ১৫ জনের এক ডাকাত দল। ঠিক কী হয়েছিল সেদিন রাতে? আজ সেই তথ্যই তুলে ধরবো। দিনটি ছিল ১৯৬৩ সালের ৮ আগস্ট, মাঝরাত পেরিয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ। গ্লাসকো থেকে ইউস্টনগামী মেল ট্রেন ছুটছে আপন গতিতে। চালক আর সহকারী চালকের আসনে জ্যাক মিলস আর ডেভিড হুইটবি ছিলেন দায়িত্বে। রেল-কর্মীরাও ব্যস্ত লন্ডন পৌঁছানোর আগে চিঠিপত্র, পার্সেল গুছিয়ে রাখার কাজে। সেদিন অন্যান্য বারের তুলনায় অনেক বেশি জিনিসপত্র, অর্থ, রেজিস্টার করা পার্সেল, চিঠি ঠাসা ছিল দ্বিতীয় বগিতে।
আন্দাজ ভোর তিনটে, লেইটন বুজার্ড অতিক্রম করে গেল মেল ট্রেন। সামনেই ছিল সিয়ারস ক্রসিং। আর সেখান থেকেই শুরু ডাকাতদের পরিকল্পনা মাফিক পদক্ষেপ। প্রথমেই ডাকাতরা হাতের দস্তানা দিয়ে ক্রসিংয়ের সিগন্যালের সবুজ আলো চেপে মাত্র ছয় ভোল্টের ব্যাটারির সাহায্যে একটি লালবাতি জ্বালিয়ে রেখেছিল। এটাই ছিল তাদের প্রথম ফাঁদ। আর স্বভাবতই ট্রেন চালক জ্যাক মিলস সেই ফাঁদে পা ফেলেন। ট্রেন থামতেই সহকারী চালক ইঞ্জিন রুম থেকে নিচে নেমে এলেন আর লাইনের কী সমস্যা হয়েছে জানার জন্য সিগন্যাল ম্যানকে ফোনে যোগাযোগ করতে যান। টেলিফোনের তার কাটা অবস্থায় পড়ে আছে দেখেই তিনি বুঝে যান সমস্ত ব্যাপার। তড়িঘড়ি ট্রেনে ফিরে আসার জন্য উদ্যত হলেও ততক্ষণে ডাকাত দলের একসদস্য তার উপর আক্রমণ করে ও খাড়া রেল বাঁধ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। বাকি ডাকাতরা ইঞ্জিন রুমে ঢুকে চালককে মেরে অজ্ঞান করে দেয়।
ডাকাতদের পরিকল্পনা মাফিক সবটাই ঠিকঠাক চলছিলো। শুরুতেই তাঁরা ট্রেনের প্রথম দুই বগি আর ইঞ্জিনকে বাকি ট্রেনের থেকে আলাদা করে দেয়। যে জায়গায় এই কাজ চলছিল সেটা খুব সংকীর্ণ। তাই তাদের পরবর্তী পরিকল্পনা ছিল সিয়ারস ক্রসিং থেকে মাইলখানেক দূরে ব্রাইডগ ব্রিজের কাছে তারা নিজেরাই ট্রেন চালিয়ে নিয়ে যাবে। সেখানে মাল নামিয়ে চম্পট দেবে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল ট্রেনের ব্যবস্থাপনায়। তারা বুঝতেই পারছিল না কীভাবে ট্রেন চালাবে। বাধ্য হয়ে জ্যাক মিলসকে তারা জাগায় এবং শাসিয়ে তাকে দিয়েই ট্রেন চালিয়ে নিয়ে যায়। ব্রাইডগ ব্রিজে পৌঁছে ১২০ বস্তা ভর্তি প্রায় আড়াই টন ওজনের অর্থ নিয়ে যায়। জ্যাক মিলসকে ভয় দেখিয়ে যায় যে সে যেন আগামী তিরিশ মিনিটের মধ্যে পুলিশকে না জানায়। এটিই ছিল সম্পূর্ণ ডাকাতির মধ্যে মাত্র একটা সূত্র যা ধরে পরে তদন্তকারী দল বুঝে নেয় যে মাত্র তিরিশ মিনিট দূরত্বের কোনো নির্জন স্থানেই এই ডাকাত দল গা ঢাকা দিয়েছে। আজ্ঞে হ্যাঁ, এটাই ওই ডাকাতরা করেছিল। ওকলে বাকিংহামশায়ারের জীর্ণ এক ফার্মে তারা গা ঢাকা দিয়ে টাকাপয়সা ভাগ বাঁটোয়ারা করে নেয়।
ইতিমধ্যে এত বড় ডাকাতি চারিদিকে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। চিফ সুপারিনটেনডেন্ট জ্যাক স্লিপারের নেতৃত্বে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড আর বাকিংহামশায়ারের পুলিশ ও গোয়েন্দা দল অনুসন্ধান শুরু করে। এদিকে ডাকাতদের পরিকল্পনা ছিল সপ্তাহ খানেক সেখানে গা ঢাকা দিয়ে থেকে তারপর যে যার মতো চলে যাবে। কিন্তু নিজের বখরা বুঝে নিয়ে অন্যতম সদস্য রনি বিগস তার ১ লাখ ৪৭হাজার পাউন্ড ভাগ নিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই চলে যায়। বাকিরাও ধীরে দিয়ে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকে। এতজন অচেনা মানুষকে দেখে এলাকার কিছু মানুষের সন্দেহ হওয়ায় তারা পুলিশে খবর দেয়। পুলিশ সেখানে অভিযান চালায়। যদিও অভিযানের আগেই ডাকাতরা সেখানে থেকে চম্পট দেয়। পুলিশের হাতে প্রচুর তথ্য আসে ওই ফার্ম থেকে। আঙুলের ছাপ, মনোপলি বোর্ড, কেচাপের বোতল, রেজিস্ট্রি করা খালি খাম, পোস্ট অফিসের বস্তা। একে একে ধরা পড়তে থাকে ডাকাতরা। তবে এই ডাকাতির মূল মাথা বরুস রেনল্ডসকে গ্রেফতার করতে পুলিশের সময় লেগেছিল প্রায় ৫ বছর, সাজা হয়েছিল ১০ বছর। রনি বিগসের সাজা হয় ৩০ বছর। ওই ডাকাতদলের একজন বাস্টার এডওয়ার্ডসের শেষ জীবন কাটে এক রেল স্টেশনে ফুল বিক্রি করে। চার্লস উইলসন স্পেনে আততায়ীর হাতে গুলিতে মারা যায়।
এই সুনিপুণ পরিকল্পনাকে বাস্তব করে দেখানো, কোনো আগ্নেয়াস্ত্র ছাড়া এত বড় ডাকাতি আজও টেক্কা দেবে যে কোনো পুরস্কার জয়ী সিনেমার স্ক্রিপ্টকে। তৎকালীন প্রশাসন বাধ্য হয়েছিল ‘দ্য গ্রেট ট্রেন রবারি’ আখ্যা দিতে। যদিও ডাকাতরা নিজেদের নিয়তিকে কোনোভাবেই ঠেকাতে পারেনি।
চিত্র ঋণ – History.com
Discussion about this post