“আমাদের সূর্য মেরুন নাড়ির যোগ সবুজ ঘাসে, আমাদের খুঁজলে পাবে সোনায় লেখা ইতিহাসে।” অরিজিৎ সিং-এর গাওয়া এই গানটার সুরে ভোলেননি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। ১৯৭৭ এর ২৪ সেপ্টেম্বরের কথাই যদি বলি। ব্রাজিলের অমন তাবড় ফুটবলারও সেদিন বাঙালির পায়ের জাদুর প্রেমে পড়েছিল। ফুটবল সম্রাট পেলে তাঁর মনে জায়গা দিয়েছিলেন এই ম্যাচকে। এমনকি ওই ঐতিহাসিক ম্যাচের পরে ৯০-এর বিশ্বকাপের সময় পেলে খোঁজ নিতে ভোলেননি সেই যাদুকরের। তার মনের মণিকোঠায় এতটাই গভীর ভাবে জায়গা করে নিয়েছিল সেদিনের ম্যাচ আর বাঙালি ফুটবলার শিবাজী ব্যানার্জী।
মোহনবাগান বনাম কসমস ম্যাচের প্রস্তুতি সেদিন তুঙ্গে। ম্যাচের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন শিবাজী ব্যানার্জি। তার বাবা সুবোধ ব্যানার্জি এসে বললেন, “যদি পেলে ফ্রি-কিক্ মারতে যান, তাহলে বলের জন্য এগোবি না। বলকে তোর কাছে আসতে দিবি।” তিনি নিজেও ছিলেন একজন বিখ্যাত গোলকিপার। ১৯৩৬ সালের ৪ জুলাই চীনা অলিম্পিক দলের সাথে ভারতীয় একাদশের ম্যাচে ভারতীয় দলের গোলকিপার ছিলেন সুবোধ ব্যানার্জী। মোহনবাগান, কালীঘাট দলে খেলেছিলেন তিনি। আর সেদিন যোগ্য বাবার এই শিক্ষাই হয়ত যোগ্য সন্তান শিবাজীকে এগিয়ে রেখেছিল পেলের মনে জায়গা করে নেওয়ার প্রথম ধাপে। আর সেদিনের ম্যাচে যে দুরন্ত পারফরম্যান্স দেখিয়েছিলেন শিবাজী তা তো বলাই বাহুল্য।
কলকাতার মোহনবাগান ও পেলের টিম কসমসের ম্যাচ সেদিন ২-২ গোলে ড্র হয়। অসম্ভব ভালো খেলেছিলেন শিবাজী ব্যানার্জি, সুব্রত ভট্টাচার্য, হাবিব, বিদেশ বসু, শ্যাম থাপা, সুধীর কর্মকার, প্রসুন ব্যানার্জি, গৌতম সরকাররা । পি কে ব্যানার্জি গৌতম সরকারকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন পেলেকে অকেজো করার। তা দায়িত্ব সহকারে নিষ্ঠার সঙ্গে পালনও করেন তিনি। তার মধ্যেও একবার বল নিয়ে পেলে ঢুকে যায় মোহনবাগানের বক্সে। গোল অবধারিতও ছিল। কিন্তু কোনো কিছুর পরোয়া না করে পেলের পায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বল তুলে নিলেন শিবাজী ব্যানার্জী। বিপক্ষের গোলকিপারের যাতে আঘাত না লাগে সেজন্য পেলে শিবাজীর উপর দিয়ে লাফ দিয়ে নিজে জালে জড়িয়ে গেলেন। এক অসাধারণ খেলোয়াড়ি মনোভাবের সেদিন পরিচয় দিলেন পেলেও। আর তার সাথে সাথেই বড়োসড়ো এক দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষাও পেলেন শিবাজী ব্যানার্জী।
পেলের কলকাতা সফর ও ফুটবল ম্যাচ যে শুধুমাত্র পেশাগত নয় তা সেদিন বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের গান নিয়মিত শুনেছিলেন ফুটবল-সম্রাট। সেদিনের মেডেল দেবার অনুষ্ঠানে শিবাজী ব্যানার্জিকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাওয়া কিংবা ব্র্যান্ড ডিনারে শিবাজীকে দেখে বলে তার বলে ওঠা- “ওহ, দিস ইজ গর্ডন ব্যাঙ্কস, সেভ্ড হিজ টিম টুডে!” এসবই পেলের অসাধারণত্ব এবং মানবিক মনের পরিচয় দিয়েছিল। এমনকি শুধুমাত্র ম্যাচের সময় বা ম্যাচের পরমুহূর্ত নয় তার বহু বছর পরেও পেলে বারংবার শিবাজী ব্যানার্জির কথা জিজ্ঞাসা করেছেন বিভিন্ন জনকে। তিনি চেয়েছিলেন দুজনের মধ্যে আবারও সাক্ষাৎ হোক। যদিও যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতার তা আর হয়ে ওঠেনি। ১৯৭৭ সালে এক অসাধারণ ম্যাচের সাক্ষী থেকেছিল কলকাতাবাসী। সাক্ষী ছিল এক হার না মানা লড়াইয়ের। সাক্ষী ছিল বাঙালি খেলোয়াড়ের দুর্ধর্ষ পারফরম্যান্স আর সাহসের যুদ্ধের।
Discussion about this post