উনিশ শতকের কলকাতার ধনী বাবুরা নানা ধরনের অদ্ভুত শখ পোষণ করতেন, এই কথা কারো অজানা নয়। পায়রার বিয়ে দেওয়া, বেড়ালের বিয়ে দেওয়া, পুতুলের বিয়েতে লোক খাওয়ানো। কিন্তু জোড়াসাঁকোর এই জমিদারের শখ নিঃসন্দেহে সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ব্রাহ্মণদের টিকি কেটে তা সংগ্রহ করাই ছিল তাঁর এক অদ্ভুত নেশা। শুধু শখ নয়, এর পিছনে অবশ্য ছিল এক বিশেষ উদ্দেশ্য। সমাজের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, টিকি রাখা এবং নির্দিষ্ট আচরণ মেনে চলাই ব্রাহ্মণত্বের চিহ্ন বলে গণ্য হতে। এই জমিদার যাচাই করতে চেয়েছিলেন, ব্রাহ্মণ ও টিকি মাত্রেই কি প্রকৃত পাণ্ডিত্যের অধিকারী?
তিনি আমাদের সকলের পরিচিত ‘হুতোম প্যাঁচা’। কালীপ্রসন্ন সিংহ। একবার জমিদারবাড়িতে এক ব্রতে ব্রাহ্মণদের গরু দান করা হয়েছিল। কিন্তু দানের গরু নিয়েই এক ব্রাহ্মণ সোজা কসাইখানায় গিয়ে সেটি বিক্রি করে দেন। এই সংবাদ কানে আসতেই কালীপ্রসন্ন রেগে ওঠেন এবং সেই ব্রাহ্মণকে ধরে এনে প্রকাশ্যে শাস্তি দেন—টিকি কেটে নেওয়া হয় তার। এই ঘটনার পর থেকেই কালীপ্রসন্ন স্থির করেন, সমাজে যারা শুধু পদবির জোরে ব্রাহ্মণত্বের সুবিধা নিচ্ছে, অথচ প্রকৃত পাণ্ডিত্য বা সৎ চরিত্রের ধার ধারে না, তাদের মুখোশ তিনি খুলে ছাড়বেন।
এরপর থেকেই তিনি নিয়মিত ব্রাহ্মণদের তর্কযুদ্ধে আহ্বান জানাতে শুরু করেন। নিজে স্কুলছুট হলেও বিদ্যা ও বাগ্মিতায় তিনি ছিলেন অতুলনীয়। ফলে সাধারণ ব্রাহ্মণদের পক্ষে তাঁর সামনে দাঁড়ানো কঠিন হয়ে পড়ত। তর্কে পরাজিত হলে তিনি তাদের টিকি দাবি করতেন, যেন তাদের ভুয়ো পাণ্ডিত্যের প্রতীকটিকে নামিয়ে ফেলতে চান। তবে বিনিময়ে মোটা দক্ষিণাও দিতেন পরাজিত ব্রাহ্মণদের। একসময় টিকি সংগ্রহ করাটা তাঁর কাছে এক নেশায় পরিণত হয়, এবং তিনি আলমারিতে চিরকুটে লিখে টিকিগুলো গুছিয়ে রাখতে শুরু করেন।
এইভাবেই কালীপ্রসন্ন সিংহ একান্নটি টিকির মালিক হয়ে ওঠেন এবং ‘টিকি কাটা জমিদার’ উপাধি লাভ করেন। মাত্র ত্রিশ বছরের জীবনকালে তিনি মহাভারত অনুবাদ, নাটক রচনা ও মঞ্চস্থকরণ, সমাজ সংস্কার, এবং সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে গিয়েছেন। তাঁর বিখ্যাত রচনা ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ তৎকালীন কলকাতার বাবু সংস্কৃতি ও সমাজের ভণ্ডামিকে নির্মম ব্যঙ্গের মাধ্যমে তুলে ধরেছিল। তাঁর টিকি সংগ্রহের ঘটনা যেমন বিস্ময়কর, তেমনই তা ছিল তাঁর সমাজ সচেতনতামূলক দৃষ্টিভঙ্গিরই অংশ।







































Discussion about this post