পৃথিবীর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সুরকারদের একজন মনে করা হয় কাকে? লুডউইগ ফান বেথোভেন কে। এ সবাই জানে। তিনি পাশ্চাত্য সঙ্গীতের ধ্রুপদী ও রোমান্টিক যুগের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। তাঁর প্রতিভা পরবর্তী প্রজন্মের সুরকারদের অনুপ্রাণিত করেছে এবং এখনও করে চলেছে। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা হল, তিনি যে সময়ে তাঁর শ্রেষ্ঠ সুরগুলি তৈরি করেছিলেন, সেই সময় তিনি ছিলেন শ্রবণশক্তিহীন, অর্থাৎ পাতি ভাষায় ‘কালা’! এখন মজার বিষয়, আমাদের বাংলাতেও এমনই একজন শিল্পী ছিলেন, যিনি ‘কালা’ না হলেও ছিলেন অন্ধ। তাঁর শারীরিক প্রতিবন্ধকতা কে সরিয়েই তিনি হয়ে উঠেছিলেন সেই সময়ের একজন অন্যতম সঙ্গীত শিল্পী।
কথা হচ্ছে কৃষ্ণচন্দ্র দে কে নিয়ে। তাঁর অন্তর্দৃষ্টি দিয়েই তিনি সুরসাধনা করেছিলেন। রাগাশ্রয়ী সঙ্গীতের পাশাপাশি তাঁর কণ্ঠে কীর্তন শ্রোতাদের অন্তরকে ছুঁয়ে অদ্ভুত এক আবেশ তৈরি করত। অথচ তিনি ছিলেন দৃষ্টিহীন। পঙ্কজকুমার মল্লিক বলেছিলেন, ‘‘সে যুগের শ্রেষ্ঠ পুরুষ গায়ক কৃষ্ণচন্দ্র দে।’’ সৌম্যকান্তি, সদাহাস্যময় এবং মিষ্টভাষী এই সুরসাধক ছিলেন শৌখিন। সব সময়ে পরিপাটি বেশভূষায় থাকতে ভালবাসতেন। ব্যাক ব্রাশ করা চুল আর গায়ে থাকত সিল্কের পাঞ্জাবি, কোঁচানো ধুতি।
কিশোর বয়সে ছাদ থেকে ঘুড়ি উড়িয়ে নীচে এসে কৃষ্ণচন্দ্র মাকে বলেছিলেন তাঁর চোখ জ্বালা করছে। সেই শুরু। বড় বড় ডাক্তার এসেও কৃষ্ণচন্দ্রের চোখের পরীক্ষা করে আশার কথা শোনাতে পারেন নি ৷ একদিন কৃষ্ণচন্দ্র শোওয়ার আগে চোখের ড্রপ দেওয়ার পরে আর দেখতে পেলেন না। হয়ে গেলেন সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন ৷ মা রত্নমালা দেবী লক্ষ করতেন কোনো কীর্তনীয়া যখনই বাড়ি বাড়ি খঞ্জনী বাজিয়ে কীর্তন শুনিয়ে যেত, তার পরেই অন্ধ কৃষ্ণচন্দ্র গানগুলো হুবহু গেয়ে দিত। সুর বা কথার কোনো নড়চড় হতনা। তিনিই ছেলেকে গান শেখানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন ৷ কৃষ্ণচন্দ্রের গুরু ছিলেন হরেন্দ্রনাথ শীল।
১৮ বছর বয়সে কৃষ্ণচন্দ্রের প্রথম গানের রেকর্ড বেরিয়েছিল এইচএমভি থেকে। হরেন শীলের বাড়িতে গ্রামোফোন কোম্পানির ভগবতীচরণ ভট্টাচার্য তাঁর গান শুনেছিলেন। তিনিই কৃষ্ণচন্দ্রকে গান রেকর্ড করতে নিয়ে গিয়েছিলেন। গান দুটি ছিল ‘আর চলে না চলে না মোগো’ এবং ‘মা তোর মুখ দেখে কি’। যখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে, গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে প্রতি মাসে একটি করে রেকর্ড বেরোত। শুধু রাগসঙ্গীত নয়, আধুনিক বাংলা গানেও কৃষ্ণচন্দ্র বৈচিত্র দেখিয়েছিলেন। গায়কিতে এবং সংগীত সৃজনে নতুন এক ধারার প্রবর্তন করেন কৃষ্ণচন্দ্র। ধ্রুপদ, ধামার, খেয়াল, লোকগান কিংবা কীর্তনের সুর ভেঙে তিনি সৃষ্টি করলেন বাংলা গানের নতুন এক সম্পদ। মান্না দে বোধহয় কোনওদিন মান্না দে হতে পারতেন না, যদি কৃষ্ণচন্দ্র দে তাঁর কাকা না হতেন।
Discussion about this post