উনিশ শতকের পর থেকেই পশ্চিমের হাতফেরতা আধুনিকতার স্পর্শে বাঙালির অন্দরের ছবি ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করেছিল। বাঙালির চিরায়ত সামাজিক উৎসব-অনুষ্ঠানে লাগতে শুরু করেছিল বিদেশি হাওয়া। সালটা ১৯০৬, একদিকে স্বদেশী বিপ্লব মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে অন্যদিকে ক্রমেই বাঙালির চালচিত্রে জাঁকিয়ে বসছে পশ্চিমী প্রভাব। এই অবস্থায় কলকাতায় কুমার রামেন্দ্রকৃষ্ণ দেব তাঁর বড় ছেলের বিয়েতে আয়োজন করলেন এক অভিনব ভোজের। বরকর্তা ব্রিটিশ স্নেহভাজন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট। ছেলে তার বিলেত ফেরত আইনজীবী। ৩৬ রকমের পদ সহযোগে সেই মহাভোজে উপস্থিত ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ পুত্র হেমেন্দ্রনাথের মেজ মেয়ে প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী।
তবে ওই অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ ৩৬ রকমের পদ ছিল না, ছিল ‘মেনুকার্ড’। ষোড়শব্যঞ্জনে অতিথি আপ্যায়ন ছিল সে কালের চালু রীতি। কিন্তু কী কী পদ পরিবেশন করা হবে, তা ভোজের আগে কাকপক্ষীতেও টের পেত না। গোপনীয়তা ছিল ভোজের আর এক আকর্ষণ। এই প্রথমবার ভোজের আগেই আমন্ত্রিতদের হাতে হাতে পৌঁছে গেল পদের তালিকা। বাংলায় ছাপানো মেনুকার্ডে ছিল ৩৬ রকমের পদ। আর ফরাসি ভাষায় ছাপানো মেনুকার্ডে বিদেশি অভ্যাগতদের জন্য ছিল ১৬ রকমের পদ।
বরাবরই কিছু আধুনিক যা কিছু অভিনব, তার সাক্ষী থেকেছে ঠাকুর বাড়ি। এবারও তার অন্যথা হলনা।জানা যায়, বাংলায় ভোজের আসরে মেনুকার্ড প্রথম দেখা গিয়েছিল জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে। রবিঠাকুরের ভাইঝি প্রজ্ঞাদেবীর হাত ধরেই বাঙালির ভোজ সভায় প্রথম আত্মপ্রকাশ করে ‘মেনুকার্ড’ বা ‘ক্রমণী’। প্রথমে হাতে লিখেই ভোজনের জায়গায় ঝুলিয়ে দেওয়া হত ক্রমণী, তারপর ধীরে ধীরে সেটিকে ছাপিয়ে প্রত্যেক আমন্ত্রিতের হাত অবধি পৌঁছে দেওয়া হত।
এখন বিয়ে হোক বা রেস্তোরাঁ খেতে বসার আগে প্রথমেই হাতে আসে মেনুকার্ড। মেনুকার্ডের উপাদান থেকে ভাষা সব কিছুতেই অভিনবত্ব খুঁজতে হয়রান ক্যাটারিং কোম্পানির মালিক। মাটি, গাছের ছাল, সুপারির খোলা, কাঁসা-পিতল, কাঠ হাজারও জিনিসের তৈরি মেনুকার্ডে অভিনব ভঙ্গীতে লেখা খাবারের পদ বিয়ে বাড়ির অন্যতম আকর্ষণ। কিন্তু তৎকালীন সময়ে ‘মেনুকার্ড’ এত সহজলভ্য ছিলনা, উনিশ শতকের প্রথম দিকে এই মেনুকার্ড মূলতঃ ধনীরাই ব্যবহার করতেন।
Discussion about this post