ছাত্রের গবেষণা পত্র চুরির দায়ে অভিযুক্ত সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের জন্মদিন ৫ সেপ্টেম্বরকে শিক্ষক দিবস হিসেবে ভারতে পালিত হয়। যদিও ডেইলি নিউজ রিল গণমাধ্যম ৫ সেপ্টেম্বরের বদলে ২৬ সেপ্টেম্বর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মদিনটিকে শিক্ষক দিবস হিসেবে পালন করছে। আমাদের চোখে চার সামাজিক শিক্ষক তাদের ছাত্রদের উদ্দেশ্যে কী বলছেন চলুন দেখে নেওয়া যাক।
গাবু গৌরব, লক্ষ্মীছাড়া ব্যান্ড সদস্য – আমি সবসময় চেষ্টা করি আমি যা জানি তা বাকি ছাত্রদেরকেও জানানো। শুধু যে ড্রামস বা সঙ্গীতের ক্ষেত্রেই এটি প্রযোজ্য সেটাও নয়, জীবনের অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রেও তা খাটে। আমি চেষ্টা করি আমার ছাত্রদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার। আমার ছাত্ররা সমসাময়িক অনেক ব্যান্ডের সাথে বাজায়। এমনকি একই মঞ্চে পারফর্মও করেছি আমরা। ছাত্রদের এইরকম সাফল্যে আমার যা অনুভূতি তা বলে বোঝানোর নয়। সত্যিই তা অসাধারণ এক অভিজ্ঞতাই বটে।
প্রতাপ দাস , সহ-সম্পাদক, সারা ভারত বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সংস্থা – আমাদের দেশে যত না মনীষী জন্মায়, তার চেয়ে বেশি ‘নির্মাণ’ হয়। শিক্ষক দিবসও তেমনি এক রাজনৈতিক ফন্দির মতলবি উদযাপন । ক্ষমতাসীন শাসকরা তাদের নিজের নিজের মতাদর্শের নিরিখে ‘তাদের মনীষী’দের চরিত্র চিত্রণ করান। তথাকথিত শিক্ষক দিবসও তেমনই এক রাজনৈতিক নির্মাণ। ৫ সেপ্টেম্বর যাঁকে কেন্দ্র করে শিক্ষক দিবস পালন করা হয়, সেই সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ সম্পর্কে আমরা, সাধারণ মানুষরা সবটা জানি কি! মহান ব্যক্তিত্বের আড়ালেও যে মহান কিছু গোপন-রহস্য থাকতে পারে, তা আর ক’জনই বা জানে বলুন! শিক্ষক শিক্ষিকারাও না জেনে, না বুঝে শিক্ষক দিবসে মেতে উঠেন। সরকার পোষিত শিক্ষালয়ের পেশায় (এমনকি বেসরকারি হলেও) থাকতে গেলে এ দিবস উদযাপন না করে উপায় নেই। অনেকে আবার ধূমধাম করে রাধাকৃষ্ণণের জন্মদিন পালন করে গর্ববোধ করেন, শিক্ষক হিসেবে শ্লাঘা বোধ করেন। কিন্তু একবারও কি ভেবে দেখেছেন, কেন ওঁনার জন্মদিনটাকে শিক্ষক দিবস হিসাবে পালন করা হয়।
একজন থিসিস চোরের জন্মদিন ৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবস হিসাবে কখনোই পালন করা উচিৎ নয়। কারণ রাষ্ট্র এটা করে জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। তাহলে আমরা কার জন্মদিনে শিক্ষক দিবস পালন করবো। আমরা বিদ্যাসাগরের জন্মদিনটাকেই শিক্ষক দিবস হিসাবে পালন করবো। কিন্তু কেন করবো? বাঙালি জাতিকে শিক্ষাঙ্গনে পৌঁছে দিয়েছেন যিনি, যিনি বর্ণের সাথে প্রথম পরিচয় ঘটিয়েছেন, যিনি মাতৃভাষার মাধ্যমে বাংলায় শিক্ষার বুনিয়াদ গড়ে তুলেছিলেন, যিনি বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানীদের পরিচয় ঘটিয়েছেন, যিনি শিক্ষাকে ধর্মমুক্ত করতে চেয়েছিলেন এবং বৈজ্ঞানিক শিক্ষা পদ্ধতি চালু করেছিলেন, নারী শিক্ষার প্রসারে যিনি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন, শিক্ষকতার সাথে মানবিকতা এবং এবং বিজ্ঞানমনস্কতার কথা বলেছিলেন সেই বিদ্যাসাগরের জন্মদিনটাকে বাংলায় বাংলীর জাতিসত্ত্বার জাতীয় শিক্ষক দিবস হিসাবে পালন করা উচিৎ।
প্রবাল চক্রবর্তী, শিক্ষক – ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ যে তার ছাত্র যদুনাথ সিংহের থিসিস প্রায় হুবহু টুকে বই আকারে প্রকাশ করে দিয়েছিলেন সে কথাটা এখন সর্বজনবিদিত। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, এই বিতর্কিত স্বঘোষিত মহাপুরুষের জন্মদিনের পরিবর্তে কোন দিনটিকে বাস্তবেই শিক্ষক দিবস হিসাবে পালন করা যায়? রাধাকৃষ্ণণের জন্মদিন ৫ সেপ্টেম্বরের ঠিক ২১ দিন বাদে আরেকজনের জন্মদিন যিনি বাংলা তথা ভারতে শিক্ষার বিস্তারে অবিসংবাদিত পথিকৃৎ। যাঁকে আমরা বিদ্যাসাগর বলে জানি। প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য শিক্ষার সম্মিলনে এক অনবদ্য পাঠ্যক্রম নির্মাণের মাধ্যমে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। বাংলা ভাষা বাংলা বর্ণমালা বাংলা ব্যাকরণ কে যেরকম যুক্তিগ্রাহ্য ও বৈজ্ঞানিকভাবে তিনি সাজিয়েছেন, তা এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে সত্যিই চমকদার!
বিভিন্ন সামাজিক সংস্কার ছাড়াও শুধুমাত্র শিক্ষা বিস্তারের কথাই যদি বলি তাহলেও তিনি সাগর বৈকি। পূর্ব ভারতের নারী শিক্ষার বিস্তারে তাঁর অবদানকে অস্বীকার করা মানে নিজের অতীতকেই অস্বীকার করা। যে কঠিন পরিশ্রম এবং বিরোধিতার মুখে দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে এই কাজগুলি তিনি করে গেছেন তাতে তাঁকে বীর সংগ্রামী বললেও অত্যুক্তি হবে না। হাজারো লাঞ্ছনা এমনকি প্রাণের ঝুঁকিকে একের পর এক মাইলস্টোন স্থাপন করা এই মহামানবের জন্মদিনই হওয়া উচিত জাতীয় শিক্ষক দিবস। সরকারি স্কুলের একজন শিক্ষক হিসেবে আমি প্রতিদিন শত শত ছাত্রীদের সামনে দাঁড়িয়ে আমার সাধ্যমত পাঠ দান করি। এই মেয়েরা যে আজকে স্কুলে আসতে পারছে তার পেছনে মুখ্য অবদান কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরেরই। তাই সার্বিক বিচারে কোন থিসিস চোর মেগালোম্যানিয়াকের জন্মদিন নয়, বিদ্যাসাগরের জন্মদিনই হওয়া উচিত জাতীয় শিক্ষক দিবস।
সুস্মিতা কর, শিক্ষক – এক শিক্ষিকা হিসাবে আমার কাছে শিক্ষক জীবনের অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ এবং পরিপূর্ণ। আমি সবসময় চেষ্টা করেছি আমার ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিদিন তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়ার। তাদের সামগ্রিক উন্নতিতে আমার সহযোগিতা তাদের সাথে সবসময় ছিল ও থাকবেও। শিক্ষক জীবনের প্রথম দিন থেকেই আমি আমার সহকর্মীদের থেকে সহযোগিতা ও আদরের মাধ্যমে আমার পেশার ক্ষেত্রে যথাসাধ্য দক্ষতা অর্জন করতে পেরেছি। একজন শিক্ষিকা হবার আগে আমি মনে করতাম যে, বাচ্চারা হয়তো খুবই দুষ্টু হয়। তাই হয়তো একদমই কথা শুনবে না, খুব কড়া শাসনে রাখতে হবে। কিন্তু, ধীরে ধীরে বুঝতে শিখলাম যে সঠিক ভালোবাসা আর যত্ন পেলে ওরাও শিক্ষক- শিক্ষিকাদের ভালোবেসে সব কিছুই করতে পারে।
আমার শিক্ষকতার জীবনে আমি যেমন পেয়েছি অনেক দুষ্টু-মিষ্টি ছাত্রছাত্রীদের, যারা সারাদিন ক্লাস মাতিয়ে রাখে। তেমনি পেয়েছি গুরুগম্ভীর, এককথায় বলতে গেলে কিছু ‘সিরিয়াস’ পড়ুয়াদেরও। এরা আবার পড়ার সময় বেশি হাসি মজা করতে নারাজ। আবার কেউ কেউ আছে বেজায় লাজুক, তাদের সাথে খোলামেলাভাবে মিশতেই হয়তো বছরের অর্ধেক সময় পেরিয়ে যায়। তবে, যে যেমনই হোক আমি সবসময় চেষ্টা করি তাদের কড়া শাসনে না রেখে তাদের সাথে বন্ধুর মতো মিশে সবকিছু বোঝানোর। সারাদিন ওদের সাথে কাটালে জীবনের সব কঠিন মুহূর্তগুলো ভুলে থাকতে পারি। আমি চেষ্টা করব আগামী দিনগুলোতেও যেন এভাবেই শুধুমাত্র শিক্ষিকা না, একজন বন্ধু ও পথ প্রদর্শক হয়েও আমার ছাত্রছাত্রীদের তাদের জীবনে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহযোগিতা করে যাওয়ার।
Discussion about this post