১৯৭১ সালটি ভারতের প্রতিবেশী বন্ধুর প্রত্যেকটি নাগরিকের কাছে খুব গর্বের একটি সাল। তবে এই গর্বের অনুভূতি পাওয়াটা যে খুব সুখকর ছিল না তা ইতিহাসের পাতা থেকে আমরা জানতে পারি। ‘অপারেশন সার্চলাইটে’ প্রাণ দিয়েছেন হাজার হাজার নিরস্ত্র বাঙালি। পাকিস্তানিদের আদেশের একচুল এদিক ওদিক মানেই মৃত লাশের স্তূপ। হত্যা ছিল সেই সময়কার দৈনন্দিন এক ঘটনা। আমরা জেনেছি অনেক কিছুই, তবে সবটুকু ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পায়নি তা বলাই বাহুল্য। তেমনই এক ঘটনার সাক্ষী থেকেছে গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার কান্দি ইউনিয়নের একটি গ্রাম তারাকান্দা। ১৯৭১ সালে কোটালীপাড়ার বিভিন্ন গ্রাম পাকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়েছিল। তবে এই গ্রামের মতো এত মানুষকে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়নি কোথাও।
১৯৭১ সাল মানেই দেশ জুড়ে যুদ্ধের পরিবেশ। কান্দি ইউনিয়নের মানুষজন তখন দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তারাকান্দরের বালা বাড়িতে প্রতিরোধ শিবির গড়ে তুলেছিল। তাদের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গা থেকে আশ্রয় নিতে আসা লোকজনও ওই বাড়িতে তাঁবু খাটিয়ে তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। এই খবর যায় গোপালপুর গ্রামের রাজাকার আলবদরদের কাছে। এরপরেই তারা পাকবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে ছক কষতে শুরু করে তারাকান্দা আক্রমণের। ভারী মেশিনগানের গুলি আর মর্টার শেল ছুঁড়তে থাকে তারাকান্দার দিকে। সেই শব্দে ভয় পেয়ে পিছু হটতে থাকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরত্বে থাকা শিবিরের সমস্ত জনতা। ডোবায়, ঝোপঝাড়ে, পুকুরের কচুরিপানার মধ্যে যে যেভাবে পারে আশ্রয় নেয়। সেই সুযোগে স্থানীয় রাজাকার আলবদররা পাক বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকে পড়ে তারাকান্দা গ্রামে।
বেলা ১১টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলতে থাকে নির্মম অত্যাচার। প্রতিরোধকারীদের দা, কুড়ুল নিয়ে পাকবাহিনীর দল নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করে শতাধিক নারী, পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধদের। এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞে রেহাই পায়নি কেউই। গ্রামের এক স্থানীয় বাসিন্দা তার স্মৃতির ঝাঁপি খুলে এক ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। তার বাড়ির সামনে পুকুরের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে একটা ডোবার মধ্যে লুকিয়েছিল ৯ জন। তাদের প্রত্যেককে গুলি করে বা কুপিয়ে অথবা নির্মম অত্যাচার করে হত্যা করে পাক সেনাবাহিনী। এখনও সেই ভয়াল দৃশ্য ভেবে কেঁপে ওঠেন তিনি। পুকুর পাড়ে পড়েছিল সারি সারি মৃতদের লাশের মধ্যে । এখানেই শেষ নয়, নারী নির্যাতন, লুটপাট ও ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে ছারখার করেছিল পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা। তারা এই হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল তারাকান্দা থেকে নলভিটা পর্যন্ত।
দুঃখের বিষয় এই যে, দেশ স্বাধীনের ৫২ বছর পরও এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে স্থানীয় প্রশাসন কিংবা সরকারের তরফ থেকে কোনো সাড়া মেলেনি। কারণ একাত্তরের এইসব মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ মনে রাখেনি। এমনকি তারাকান্দার এই গণহত্যার কথা অনেক মানুষ জানেও না। তাই এলাকার মুক্তিযোদ্ধা তথা শহীদ পরিবার ও গ্রামবাসীরা সকলেই হতাশ। গ্রামে নেই কোনো স্মৃতিফলক। তাই এখন স্থানীয় মানুষের দাবি, একাত্তরের সেই সমস্ত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা খুঁজে বের করে তাঁদের স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হোক।তাতে অন্তত শহীদ পরিবার গুলির ক্ষতে কিছুটা হলেও প্রলেপ দেওয়া যাবে।
Discussion about this post