‘জন্মদাতা’! আজ্ঞে হ্যাঁ, বাংলা রকের জন্মদাতা। বাংলা গানেও যে রক হতে পারে, এই বিশ্বাসটা করতে শিখিয়েছিলেন মহীনের ঘোড়াগুলি। তাদেরই এক জীবিত ঘোড়া তাপস বাপি দাসের আস্তাবলে হাজির হয়েছিল ‘ডেইলি নিউজ রিল’। নানা জানা-অজানা তথ্য, মান-অভিমান, স্বপ্ন, গান ঠিকরে বেরল তাপস বাপির গলা থেকে। আপনাদের জন্য রইল সেই পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকারটি।
‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ বলতে গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের নামই উঠে আসে কেন?
মহীনের ঘোড়াগুলির ব্যান্ড লিডার ছিল মনিদা (গৌতম চট্টোপাধ্যায়) সেটা প্রথম কারণ, দ্বিতীয় মনিদা প্রতিভাবান সৃষ্টিশীল শিল্পী, বিশেষত জনপ্রিয় মানুষ। ভীষন ভাল কথা বলতে পারতো – হিপনোটিক। মিডিয়া আর একটা কারণ। ১৯৭৫-৮০ তখন গৌতম চট্টোপাধ্যায়র শিল্পী সত্ত্বা একই। আপনি যে প্রশ্নটা করলেন তখন সে প্রশ্নটা আসতো না। মণিদার আমাদের ছেড়ে চলে যাবার পর বোধ হয় ‘নাম’টার বিক্রয় যোগ্যতা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। সেজন্য গৌতম চট্টোপাধ্যায় ও ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ মিডিয়াতে একটা বহু কথিত নাম হয়ে গেল। We are proud of him.
বাংলা গানের স্বর্ণযুগ। হেমন্ত মান্না শ্যামলরা তখন খ্যাতির মধ্যগগনে। সেইসময় এমন বাংলা ব্যান্ডের মতো ব্যতিক্রমী চিন্তা আনার সাহস পেলেন কীভাবে?
আমরা সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী নই। বাম-ডান ইস্তেহারে বিশ্বাসী নই। আমাদের বিশ্বাস ছিল নকশালবাদী আন্দোলনে। আমি আর মণিদা দুজনেই চাকরি ছেড়েছিলাম। তখন ছিল বিপ্লব প্রেম। সামনে দেখতে পেতাম বিপ্লব। কিন্তু ‘৬৮-‘৭২-এ নকশালবাদের অস্তিত্ব সম্পূর্ণ হারাল। যারা ছিল বিদেশ পালাল, নয়তো দল পরিবর্তন করে নিল। এমনকি আমাদের মণিদাকে কলকাতাতে তিন বছর না ঢোকার মুচলেকা জমা দিতে হল। সুতরাং বাঁচার তাগিদে আমাদের কিছু করতে হতই। তখন দেখলাম আমাদের গলায় সুর আছে। গীটার বাজাতে পারি, গান লিখতে পারি, সুরও দিতে পারি। এই হিসেবেই আমাদের তথা বাংলা ব্যান্ডের শুরু। তবে শুরুতে আমরাও জানতাম, দর্শক হবে না। তবু এটা মানতাম, যে সময় একদিন বদলাবে। একদিন ওই প্রথা ভাঙবে। ২০০২-‘০৪ সালে অনেকটা বদলে যায় মানুষের পছন্দ। অর্থহীন দলই হয়ে ওঠে অর্থবহ। তো এককথায় পলিটিক্যাল অবিশ্বাস থেকেই এই সাহস জন্মায়।
বাংলার রক থেকে কীভাবে জ্যাজ বাউল জঁরে এল ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’?
সত্যি বলতে খুব একঘেয়েমি লাগছিল। সেই একই মিউজিক। একইরকম সব। এই দলের উদ্দেশ্য তো ছিল বাংলার গানের জগতে নতুন কিছু। ১৯৭৮-এর শেষ দিকে আমার আর মণিদার সোশ্যাল কমিউনিকেশন ডিপ্লোমা কোর্স চলছিল। সেই সুবাদে আমরা প্রায় ২০০ খানা মেলা ঘুরেছি। বাউল মেলা, সুফী মেলা, লোকসঙ্গীত মেলা। চারজনের দল। সবার কাজও ভাগ ছিল। মণিদা গানগুলো রেকর্ড করত। আমি মূলতঃ ট্রান্সক্রিপশন বা কপি করতাম। সুনেত্রা ঘটক ইন্টারভিউ নিত। আর দীপক মজুমদার কো-অর্ডিনেশনটা দেখত। আনুমানিক ৫০০ মতো গান শুনেছি এভাবে। ওদের গানে একটা বেশ ইম্প্রোভাইজেশন অর্থাৎ উদ্ভাবনী শক্তি ছিল। সেটাই মনে লেগেছিল আমাদের। একই কথা, কিন্তু ভিন্ন আখড়ায় ভিন্ন সুর। আমরাও শুরু করলাম। তবে এদেশে ঐ জ্যাজ গানের চল খুব একটা নেই। বিদেশে যে অঞ্চলে ছিল জনপ্রিয়তা, এখন নামমাত্র চলে। তাই শুধু নিজেদের জন্য করতাম। বাইরে পারফর্ম করতে গেলে লোকে বুঝতে পারত না। ছন্নছাড়া ব্যাপার হত। ১৯৮০-এর শেষে রবীন্দ্র সদন। শেষবারের জন্য একসঙ্গে পারফর্ম করেছিলাম। তারপর দল ভেঙে গেল।
একবিংশ শতাব্দীর ব্যান্ড হলে গানের জঁর কি হতো ? বাংলার রক নাকি স্রোতে গা ভাসানো গান?
আমাদের দল তৈরীই হয়েছিল স্রোতের বিপরীতে চলতে। ওই সময় মানুষ গান মানে ভাবতো একটা শতরঞ্জি পেতে হারমোনিয়াম নিয়ে গলা সাধছেন একজন। কে তবলা বা সেতার বাজাচ্ছেন, সেটা গৌণ ব্যপার। এই ধ্যান-ধারণা ভাঙতেই দল গড়া। প্রত্যেককে সমান গুরুত্ব আমাদের ব্যান্ড গড়ে তোলা। তবে আমাদের গান রক ছিল না। হ্যাঁ এই শতাব্দীর ব্যান্ড হলে, অবশ্যই রককে প্রাধান্য দিত দল। বাংলার রকের সূত্রপাত কোথায়? বিতর্কে নাম আসে সিধু রূপমের। কিন্তু সেই ৭০ দশকে আমাদের চারিদিক থেকে সংস্কৃতি ভাঙার তকমা দেওয়া হচ্ছে। তখন টিকে থাকার কষ্টটা কাউকে করতে হয়নি। তবে সফল রক গানের শিল্পী বলতে রূপমের নামই উঠে আসবে।
১৯৭৭ সালের প্রথম অ্যালবাম রেকর্ডিংয়ের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
সে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। ১৯৭৭ সাল। প্রথম গান, ‘হায় ভালোবাসি’। রেকর্ডিং হয় ইস্ট মাস্টার্স ভয়েস (HMV)-এ। ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় কোম্পানিগুলোর মধ্যে একটি। কিন্তু এদেশে রেকর্ডিং টেকনোলজির উন্নতি তখনও সেভাবে হয়নি। মনো রেকর্ডিং, একটি চ্যানেল, মিক্সিংয়ের কোনও সুযোগ ছিল না। এখনকার মতো উন্নত স্টিরিও রেকর্ডিং আসেনি। এদিকে আমাদের হারমোনির ব্যবহার ছিল প্রথম গানে। সমস্যা খুবই। কিন্তু সুশান্তদা (সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়) ছিলেন। উনি বিদেশী প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। সুবিধে হয় তাই আমাদের।
এই বিষয়ে বলা ভালো, এর আগেও আমাদের একটা রেকর্ডিং অভিজ্ঞতা আছে। সেটা আরও খারাপ অভিজ্ঞতা। সিনেমার গানের রেকর্ডিং। রেকর্ডিং এর সময় রেকর্ডিস্ট জ্যোতিদা হঠাৎ বেস ড্রামের কানেকশন বন্ধ করে দিলেন। বললেন সাউন্ড ফেটে যাচ্ছে। তবলা ব্যবহার করতে পারো। কিন্তু বেস ড্রাম বন্ধ করতে, গানের আসল মজাটাই গেল শেষ হয়ে। যদিও সৌভাগ্যবশত সিনেমাটি মুক্তি পায়নি।
কিন্তু ১৯৭৭-এ সুশান্তদার জন্য এমন সমস্যা হয়নি। সমস্যা ছিল অন্য জায়গায়। রেকর্ডিং চলাকালীন দলের কারও কোনো ভুল হলে, আবার প্রথম থেকে শুরু। আবার ওদিকে সময়ও নির্দিষ্ট। রেকর্ডিংয়ের সময় শেষ হলেই বন্ধ করতে হত। কিন্তু আমারা তখনকার সুরের জগতে বিপ্লব আনা যুবক। আজ অবধি কোনো রেকর্ডিং-এ ঐ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়নি। আর একটা সমস্যা ছিল মাইক্রোফোনের। তিনজন ভোকালের জন্য একটিমাত্র মাইক্রোফোন বরাদ্দ। যাই হোক, সমস্যা অনেক থাকলেও পাশ্চাত্য সঙ্গীতের অনুরাগীরা কিন্তু ভালোবেসেছে। তাই রবীন্দ্র সদনে তৎকালীন হাজারটা সিট অবধি বুকিং হয়। যদিও এখনের তুলনায় তা নগন্য। এখন রূপম ইসলামের গানে তিনহাজার সিট বুক হয়েও গেট এর পাশে দাঁড়িয়ে লোক শোনে।
আজ তো সবটাই ডিজিটাল মাধ্যম। কিন্তু সেসময়ে দাঁড়িয়ে কতটা কঠিন ছিল ব্যাপারটা? গান লেখা, সুর দেওয়া। মানুষের কাছে পৌঁছোতো কীভাবে?
তখন সবটাই খোলা মাঠ,নয়ত হল বুকিং। কিংবা কনসার্ট। যদিও আমরা যে তখন বহু ভিড়ের চাহিদায় ছিলাম,তা একেবারেই নয়। আমাদের দল বেড়ে ওঠার গল্পটা অন্যরকম। ১০০ থেকে ২৫০ ভিড়ই তখন যথেষ্ট ছিল। খুব কম টাকাতেই টিকিট বিক্রি করেছি। কারণ তখন আমাদের পরিচিতিটাই বড় কথা। এ বিষয়ে একটা মজার গল্প বলি।
আমাদের বেহালাতে পাড়ায় ‘হরিভক্তি প্রদায়িনী সভা’ ছিল। আজও সেটি ‘হরিসভা’ নামেই পরিচিত। ওই সভার বাৎসরিক অনুষ্ঠান। পাড়ার এক জ্যেঠু আমাদের মনিদাকে বললেন, যাতে অনুষ্ঠানে আমাদের দল গান গায়। ওই জ্যেঠুর কোনো ধারণাই ছিল না আমরা কি ধরণের গান গেয়ে থাকি। তো অবলীলায় বললেন, “পাড়ার ছেলে তোরা। সেতার-তবলা বাজিয়ে তো গান করিস। আমাদের অনুষ্ঠানে করিস তো গান”। আমাদের গিটারকে উনি সেতার আখ্যা দিচ্ছেন। ভেবেই দেখো, আমাদের গানের ব্যাপারে কত বোঝেন। যাই হোক, ভক্তিমূলক অনুষ্ঠান যখন খিচুড়ির আয়োজন ছিল। আর সেই জন্যই মণিদা রাজি। কিন্তু বাধ সাধল বাকি সদস্যরা। পাঁচুদার চায়ের ঠেকে প্রস্তাব রাখতেই যে যার মতো ব্যাখ্যা করে সরে গেল। অগত্যা আমি রিদম গিটার আর মণিদা কোমরে বাঁধা বাউলদের মতো বাঁয়া আর ডানহাতে একতারা নিয়ে হাজির হলাম। স্টেজে উঠেই চক্ষু চড়কগাছ। দর্শকের আসনে সবচাইতে কম বয়স্ক হয়ত ৫০-৫২। বাকি ৯০ ছুঁইছুঁই। ভালো ব্যাপার বলতে আমাদের ঐ লম্বা চুল। ভক্তিগীতি দলেরই লোক ভেবে নেয় দর্শক। প্রথমেই ধরলাম, “হরি দিন তো গেল সন্ধ্যে হল পার করো আমারে।” দেখি প্রথম সারিতে বসা বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা চোখের জলে একাকার। মণিদা আমার হাত টিপে বলল, ‘গ্রিপে আছে চালিয়ে যা’। তারপর ধরলাম আমার লেখা পুরোনো একখানা গান। “ফিরে আসবো মাগো”, ছেলে মাকে ছেড়ে যাচ্ছে এই থিম। তাতে তো রীতিমত করতালি। তারপর আরও দুটো গান। ‘ভেসে আসে কলকাতা’, ‘হায় ভালোবাসি’।
সুতরাং, এটাই বলার, আমাদের প্রথম লক্ষ্য ছিল ওই ছোট ছোট জনসমষ্টিগুলো। শুধু পরিচিতিটাই দরকার ছিল। যারা সেদিন যায়নি, পরে তারাও সহমত হয়েছিল।
‘মহীনের ঘোড়াগুলি’কে বাংলা ব্যান্ডের পিতামহ ধরা হয়ে থাকে। অন্যদিকে ‘মহীন এখন বন্ধুরা’কে চেনেন না অনেকেই। তবে কি ‘মহীন এখন বন্ধুরা’ ব্যান্ড ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র ছায়া বলে ধরে নিতে হবে ?
ছায়া ঠিক নয়। কারণ ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র মত এতটা জনপ্রিয়তা পায় নি ‘মহীন এখন বন্ধুরা’। সমস্যাটা কোথায় জানো? যোগাযোগ। আর শুধু আমাদের না, যে কোনও ব্যান্ডের দলেরই স্থিরতার অভাব হচ্ছে। দল ভাঙছে। তারপর আগে আমরা বাড়িতে রিহার্সাল করতাম। এখন ভাড়া করতে হয় রিহার্সাল প্যাড যা বেশ ব্যয়বহুল। আর একটা সমস্যা হল, হল পাওয়া। অদ্ভুতভাবে এখনো অনেক হল, ব্যান্ডকে পারফর্ম করতে দেয় না। আমাদের প্রতিষ্ঠা দিবস ১২ সেপ্টেম্বর। গত বছর জ্ঞান মঞ্চে ওই দিন পারফর্ম করতে গিয়ে বেশ বিপদে পড়েছিলাম। বাধ্য হয়ে একটি নাচের পরিবেশনাকে দেখিয়ে আমাদের ব্যান্ডের পারফর্ম করা সম্ভব হয়েছিল। যাই হোক, মুখ্য কারণ হল, এটা আমাদের ব্যর্থতা ‘মহীন এখন বন্ধুরা’ জনপ্রিয়তা পায়নি। আর এ বছর করোনা-পরিস্থিতিতে অনেক প্রোগ্রাম বাতিল গিয়েছে। ক্ষতি হয়েছে বেশ। প্রশ্নের শুরুতেই ফিরছি। ‘মহীন এখন ও বন্ধুরা’ মহীনের ঘোড়াগুলির ছায়া নয়, বরং উত্তরসূরী।
সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো, যা আমাদের ভাবাচ্ছে পোড়াচ্ছে বা আলোকিত করছে, সেসব কি আদৌ ‘মহীন এখন ও বন্ধুরা’র গানে ছাপ ফেলছে?
অবশ্যই ছাপ ফেলেছে। ২০১৫, ২০১৮, ২০১৯ আর এবছরও যেকটা ডিস্ক বেরিয়েছে, সবগুলো দেখতে পারো। একটাতেই শুধু লালন ফকিরের গান আছে।বাকি সবকটা আমার লেখা। সবকটাই বাস্তবের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
“একসময় তোমার উঠোনে আমি দেখেছি চাপ বাঁধা রক্ত/ আজ তুমি কাঁচঘরে সে রক্ত তো বহুদূর/ তুমি তোমার কাঁচঘরে অন্য কোনো শব্দ পর্যন্ত ঢোকে না/ একসময় বেয়োনেট বুকে তুমি এগলি ওগলি পালাচ্ছিলে/ সেদিন ভুলে গিয়ে ঠিক/ এই মূহুর্তে তুমি মাটি থেকে অনেক উঁচুতে মেঘবালিকার হাতে সুরা পান করছ”। এছাড়া ‘ফেসবুক’ নিয়েও লেখা আছে একখানা। সর্বশেষ রিলিজ ‘বনপাখি’। সেখানে যেমন নগরায়ণের ওপর এক অভিমানের সুর। “নির্বান্ধব বসত ছেড়ে আমি বন্ধুর হেঁশেলে যেতে চাই”। খেজুরে আলাপ করা ড্রয়িংরুমের বন্ধু চাই না আমার। এমন গাঢ় বন্ধুত্ব চাই, তার হেঁশেল অবধি অধিকার আমার। আকাশছোঁয়া বসতে ফিরতে চাই না। মেকি আধুনিকতা অর্থাৎ কংক্রিটের জঙ্গলের বাইরেও এক দুনিয়া আছে। তাদের গানও বনপাখির সুরে মেলে। তবে ওই আমি-তুমির প্রেমের গান, ওসব পাবে না। না আগে ছিল, না ভবিষ্যতে পাবে। কল্পদুনিয়ার প্রেমে আমাদের সুখ নেই। প্রেমের গান থাকলেও, তার দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তববাদী।
প্রতিভা, টিম ওয়ার্ক, আর যোগাযোগ। সফল ব্যান্ড হতে এগুলোই কি যথেষ্ট?
প্রতিষ্ঠিত বা সফল হওয়া, ব্যাপারটা আপেক্ষিক। তিনটে স্করপিও,দুটো এসি ফ্ল্যাট, প্রচুর অর্থ। এটাও কারোর কাছে সফলতার ব্যাখ্যা। কিন্তু আমাদের দলের লক্ষ্য এমন ছিল না। আমাদের উদ্দেশ্য হল, সোজাসাপ্টা ভাষায় মনের কথা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। আমরা যেমনটা ভাবছি, তেমনটাই মানুষের মনে জায়গা করতে চেয়েছিলাম। আমরা প্রতিষ্ঠা বলতে তাই বুঝতাম। আমাদের তাতে কিঞ্চিৎ উপার্জন হলেও, আপত্তি ছিল না। শ্রোতার অবসরের সঙ্গী হোক আমাদের গান। সেদিক দিয়ে আমরা সফল ছিলাম।
হ্যাঁ, যোগাযোগ মাধ্যম কিন্তু এই পরিসরে খুবই কার্যকরী। চেনা-পরিচিতির সংখ্যা থাকলে সফলতা পেতে সুবিধে। সে যেকোনো ক্ষেত্রে। তবে ব্যতিক্রম তো থাকেই। আর যেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, তা হল অনুশীলন, টিম ওয়ার্ক।
বাংলার ব্যান্ড ঘিরে পলিটিক্স কান পাতলেই শোনা যায়। পঞ্চাশ বছর আগে এর রূপ ঠিক কেমন ছিল? এখনের সঙ্গে কোন মিল পান?
না। আসলে বর্তমান পলিটিক্সের ধরনটা অন্যরকম। আগের পলিটিক্স অন্যরকম ছিল। শোনা যায়, সুবীর সেনের গলা নাকি অবিকল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো ছিল। তিনটে হিন্দি ছবিতে গানও করেন। তারমধ্যে একটি আবার দেবানন্দের সিনেমা। খুবই জনপ্রিয় হয় সিনেমাটি। কিন্তু হেমন্তবাবু তখন মুম্বাইয়ের এক প্রতিষ্ঠিত শিল্পী, আবার সিনিয়র। তাই সুবীর সেনকে সরানো হল। আর কোনোদিন তার গান শোনা যায় নি। এটা তখনকার পলিটিক্স।
এখন সম্পূর্ণটা সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রিত, যার খারাপ শিকার অনেকেই হয়েছেন। আবার এমন অনেকে আছে, যারা অকারণেই নাম পেয়েছে। সেটার যোগ্য তারা নয়। এছাড়াও অন্যান্য পলিটিক্স আছেই। যেমন নতুন কেউ এলে, তাকে সেভাবে গ্রহন করা হয়না। তারপর আগে রেকডিংয়ে উপার্জন করা হতো। এখন উল্টোটা। টাকা দিয়ে রেকর্ড করতে হয়। আর পাবলিসিটির দায়িত্ব শিল্পীর নিজের। কোম্পানী সে বিষয়ে মাথা ঘামাবে না। এভাবে নিজেদের বিক্রি করে শিল্পীরা। এখন ব্যাপরটা এমনই, যাদের জনসমাদর আছে, তাদের দায়িত্ব কোম্পানী নিতে রাজি। নতুন মুখে ভরসা করতে চায় না তারা।
নতুন মুখ শিল্পীদের কাছে এভারেস্ট শিখরে চড়ার মাধ্যম রিয়েলিটি শো। এই রিয়েলিটি শো এর বিনোদনের উন্মাদনা তৈরী করে। লাখো মানুষের ঘরে পৌঁছে যায় তাদের মুখ। এই বক্তব্যের সাথে আপনি কতটা সহমত?
সহমত নই একদমই। ব্যপারটা এককথায় জঘন্য। কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত। এই রিয়েলিটি শো, ধারণাটা এসেছে তো সেই কর্পোরেট দেশ আমেরিকা থেকে। বাংলার সবচেয়ে বড় রিয়েলিটি শো, ব্যপারটা খুবই নোংরা লাগে। দেড়’শো জন মিউজিশিয়ান একটা শিল্পীর সাথ দিচ্ছে। তাও সেই পুরোনো ‘জলসাঘরে’ গানকে নতুন করে উপস্থাপন। অথচ নতুন গান যেগুলো বেরোচ্ছে, সেগুলো আড়ালে। এটা একরকম চক্রান্ত বলা যায়। সংস্কৃতিকে বহুবছর পিছিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত। যা খরচ করে ওখানে তার দশ শতাংশ ব্যান্ডের বা একক শিল্পীদের দিলে আরও নতুন নতুন গান করার সাহস পেতো ছেলেমেয়েরা।
সংস্কৃতি মানুষকে একজোট হওয়ার শিক্ষা দেয়। কিন্তু বিগত কয়েক বছর যে খারাপ সময়টা যাচ্ছে, মানুষ একজোট হতে পারছে না। কেন হচ্ছে এমনটা?
সত্যি বলতে একজোট হওয়া বহু সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। জীবনানন্দের কথায়, ‘বহু শত শতাব্দীর কাজ’। একই কথা মানতেন রবীন্দ্রনাথও। আর এই একজোট হতে না দেওয়া, একরকম প্রতিষ্ঠানিক চক্রান্ত। যখন যে সরকার এসেছে বা আসবে,তার পছন্দের কিছু শিল্পীকে এগিয়ে দেবে জনতার ভিড়ে। তবে এখনও কিছু শিল্পী আছেন, যারা স্রোতে গা ভাসাতে শেখেন নি। প্রকৃত সংস্কৃতি মনস্ক। তবে তার সংখ্যা খুবই সীমিত। তবে তাঁরা যখন একত্রিত হন, ভয়ঙ্কর চেহারা নেয়। সেটা তাৎক্ষণিক হওয়ার নয়।
‘হায় ভালোবাসি’ গানটির এদেশে জনপ্রিয়তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু কীভাবে এটা বাংলাদেশে প্রসার পেল?
১৯৭৯ সালে সাজেদ আর স্বপন নামের দুটি ছেলে আসে আমাদের কাছে। ওদের ‘সোলস’ নামের একটি ব্যান্ড ছিল, (এখনও আছে বাংলাদেশে)। আমাদের প্রথম ইপিটা নিয়ে যায়। কিন্তু ‘৮২ তে সাজেদ ডেনমার্ক চলে গেল। তখন ওর ভাগ্নেরও একটা দল ছিল। তাদের ওই গানটার রিমেক করার নির্দেশ দিয়ে গেল। ‘৮২ সালে বাংলাদেশ প্রথম এই গানটার রিমেক করল। তারপর আর একটি ছেলে, নিলয় দাস। বিখ্যাত গিটারিস্ট ও ভোকালিস্ট। ১৯৯৫-এ আবার গানটির রিমেক করে ওখানে। অর্থাৎ যখন আমরা নতুন গান নিয়ে রিহার্সাল করছি, ওরা তখনও আমাদের পুরোনো গান নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। সুতরাং এটাই বলার যে, যারা একটু অন্য চিন্তাধারার ছিল, তারা ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’কে ভালোবেসেছে। এইভাবে একটা ব্রিজ হয় দুই দেশের। ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ দল ভাঙলেও, তার ভক্ত সংখ্যা এদেশ ওদেশ এখনও আছে।
সম্পাদনা – অনন্যা করণ
Discussion about this post