ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল সারা দেশের বিপ্লবী-দল। তবে সেই আন্দোলনে এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিল আমাদের এই বাংলা। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দলে বাঙালির সংখ্যা ছিল অসংখ্য। বিশেষ করে বাংলার মেদিনীপুর জেলা ছিল বিপ্লবীদের ঘাঁটি। সেখান থেকে বহু মানুষ নিঃস্বার্থ ভাবে স্বাধীনতার লড়াইয়ে নিজেদের উৎসর্গ করেছিলেন। দেশের স্বার্থে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতেও বিন্দুমাত্র পিছপা হননি তাঁরা। তাঁদের কঠিন লড়াইয়ের ঘাম-রক্তের বিনিময়েই মিলেছে আজকের এই স্বাধীনতা। ১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট স্বাধীন হয় আমাদের দেশ, ভারত। তবে দেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক আগেই প্রায় স্বাধীনতা পেয়েছিল তৎকালীন বাংলার এক জেলা।
সালটা ১৯৪২। সেসময় বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র ছিল মেদিনীপুর জেলার তমলুক, মহিষাদল, সুতাহাটা। অত্যাচারী ও ক্ষমতালোভী ব্রিটিশদের অত্যাচারে তখন জর্জরিত দেশ সহ সারা বাংলা। তারই প্রতিবাদে তখন গর্জে ওঠেন তমলুকেরই মাতঙ্গিনী হাজরা। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ব্রিটিশদের গুলিতে প্রাণ হারালেন তিনি। ঠিক সেসময়ই ব্রিটিশ শাসনের শিকল থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হলেন তমলুকের স্বাধীনতা সংগ্রামী সতীশচন্দ্র সামন্ত। তাঁর মাথায় তখন ঘুরছে অন্য একটি চিন্তা। কীভাবে এ শাসন ছিঁড়ে নতুন এক স্বাধীন শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়! বহু চিন্তা-ভাবনার পর তাঁরই নেতৃত্বে নারকেলদহ গ্রামে একটি গোপন বৈঠক হল। নতুন এক স্বাধীন সরকার গঠনের লক্ষ্যই উঠে এল সেই বৈঠকে। মানুষের জন্য, মানুষের স্বার্থেই কাজ করবে যে সরকার৷
বিপ্লবী সতীশচন্দ্রের ভাবনা অনুযায়ীই ১৯৪২’র ১৭ ডিসেম্বর গঠিত হয় ‘তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার’। তিনিই ছিলেন এর প্রধান পরিচালক। ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থার বাইরে এই জাতীয় সরকার সেসময় এক আলাদাই শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। আইন-শৃঙ্খলা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, শিল্পের মত প্রত্যেকটি বিভাগে আলাদা ভাবে বিভিন্ন সচিবও নিয়োগ করা হয়েছিল। মানুষের সাহায্যে বারংবার ছুটে গিয়েছিল সে সরকার। অত্যাচারী শাসনের হাত থেকে মুক্ত হয়ে একরাশ শুদ্ধ বাতাসের মতই ছিল এ সরকারের বিভিন্ন কাজ।
তবে ‘সব ভালো যার শেষ ভালো’, তা কি শেষমেশ হয়েছিল? নাহ, হয়নি। কারণ শুরুটা ভালোভাবে হলেও শেষটা যে সেই ব্রিটিশদের হাতেই হতে হল! ১৯৪৩ সালের জুন মাসে গ্রেপ্তার হলেন সতীশচন্দ্র। তবে তারপরও কিন্তু এই সরকারের কাজ থেমে থাকেনি। বরং ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত স্বাধীনভাবে নিজেদের মতো কাজ করে যান সরকারে থাকা অন্যান্য বিপ্লবীরা। এলাকার বিভিন্ন ত্রাণকার্যেও সবার আগে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তাঁরাই। তবে আক্ষেপের বিষয়, সতীশচন্দ্রের গেপ্তারির পর থেকেই একটু একটু করে ভাঙ্গতে শুরু করে সরকারের অভ্যন্তরীণ গঠন। ৪৪’র ৩০শে সেপ্টেম্বরের পর থেকেই ইতিহাসের পাতা থেকে তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের অস্তিত্ব চিরতরে মুছে গেল। তবে সরকারের প্রতিষ্ঠা দিবসকে স্মরণীয় করে রাখতে আজও প্রতি বছর তাম্রলিপ্ত জনকল্যাণ সমিতির উদ্যোগে তমলুকের স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে পালন হয়ে আসছে ‘তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের প্রতিষ্ঠা দিবস’।
সব শেষে একটাই কথা বলা যেতে পারে, স্বাধীনতা পূর্ববর্তী এই সরকারের মূল উদ্দেশ্য ছিল কিন্তু একটাই। মানুষের হয়ে মানুষের জন্য লড়াই। না কোনও রাজনীতি বা না কোনও ক্ষমতা দখলের লোভ; সে সরকার লড়াই করেছিল সাধারণ কিছু মানুষের স্বাধীনতার স্বার্থেই। আজ স্বাধীনতা পরবর্তী বর্তমান পরিস্থিতিতেও একদল ক্ষমতালোভী শাসকের হাতে বন্দী আমাদের গণতন্ত্র। আজও যেখানে মানুষ, মানুষের কথা না ভেবেই মত্ত হিংসা-হানাহানিতে; সেখানে তাম্রলিপ্ত সরকারের স্বাধীন চিন্তাধারা বা মানুষের স্বার্থে নিজেদের উৎসর্গ করার সেই মনোভাব, আজও আমাদের কাছে বেশ শিক্ষণীয়ই বটে।
Discussion about this post