বর্তমান যুগ আধুনিকতার যুগ। এই যুগের প্রতিটি মূহুর্ত মানুষকে একটু একটু করে আরও উন্নত করে তুলছে। এক ক্লিকেই সারা বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তের খবর আজ আমাদের হাতের মুঠোয়। তবে এই প্রযুক্তির খারাপ দিকগুলিও আমাদের অজানা নয়। অনলাইন পোর্টাল থেকে সোশাল মিডিয়া সর্বত্রই ফেক নিউজের ছড়াছড়ি আজ। ফেক নিউজ যেন এই যুগে ক্রমশ অতি সাধারণ ঘটনায় পরিণত হচ্ছে। তবে আজ থেকে প্রায় এক শতক আগেও এমনই এক ফেক নিউজের শিকার হয়েছিলেন স্বয়ং রবি ঠাকুর।
সময়টা উনিশ শতকের প্রথম দিক। সেই সময়ে ফেক নিউজকে এতটা সহজভাবে নিতেন না সমাজের সাধারণ মানুষেরা। সেই সময়ে ছড়িয়ে পরা প্রতিটি ফেক নিউজের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। আর এই ফেক নিউজ যদি নোবেলজয়ী কবিগুরুকে কেন্দ্র করে হয়, তবে তা যে কতটা ঝড় তুলতে পারে, তা আন্দাজ করা মোটেও কঠিন কাজ নয়। তখন কবিগুরুকে নিয়ে ছড়িয়ে পড়া সেই ভুয়ো খবরের ফলে তার ভক্ত-অনুরাগীদের মধ্যে তৈরি হয় ব্যাপক বিভ্রান্তি ও উত্তেজনা। ঘটনাটি ঘটে ১৯২৯ সালের ৪ অক্টোবর। কলকাতা শহরের একটি সুপ্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্রে ছাপা হল, “আমরা বিশ্বস্ত সূত্রে জানিলাম, ‘চতুরঙ্গ’ সমিতি কর্তৃক গ্র্যান্ড হোটেলে রবীন্দ্রনাথের ‘রুদ্ররাজ’ নাটকের যে আয়োজন হইছে, বিশ্বভারতী, ব্যক্তিগতভাবে রবীন্দ্রনাথ অথবা ওরিয়েন্টাল আর্ট সোসাইটির উহার সহিত কোনও সম্পর্ক নাই।”
রবীন্দ্রনাথের নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার কথা পত্রিকায় ছাপা হতেই সারা কলকাতা জুড়ে লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে এই খবর। এক অদ্ভুত উদ্দীপনা দেখা যেতে শুরু করে। গ্র্যান্ড হোটেলের মতো একটি অভিজাত জায়গায় নাটকটি মঞ্চস্থ হবে বলে সেটির আকর্ষণও যেন কয়েক গুণ বেড়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটক দেখার জন্য সাধারণ মানুষের লম্বা লাইন পড়ে গেল। কিন্তু সকলে হোটেলে উপস্থিত হওয়া মাত্রই বুঝতে পারলেন, বড্ড বোকা বানানো হয়েছে তাদের। সেদিনের গ্র্যান্ড হোটেলে ‘রুদ্ররাজ’ নাটকটি মঞ্চস্থ হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সেটির রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নন। এই ঘটনার ফলে সাধারণ মানুষের ভাবাবেগে যে আঘাত লেগেছে, তা বুঝতে দেরি করেননি ওই সংবাদ সংস্থা। তাই ঠিক পরের দিনই সংবাদপত্র আরেকটি প্রতিবেদন ছাপল। সেই প্রতিবেদনে লেখা ছিল : “গত রাত্রে গ্র্যান্ড হোটেলে ‘রুদ্ররাজে’র অভিনয় হয়। রঙ্গমঞ্চের সাজসজ্জা প্রাচীনকালের আদর্শে। ‘রুদ্ররাজ’ শ্রীযুক্ত সুভগেন্দ্রনাথ ঠাকুরের লিখিত নাটক। ভ্রমবশতঃ আমরা পুস্তকখানি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের লেখা বলে প্রকাশ করিয়াছিলাম। লেখক কবির ভূমিকা নিজে গ্রহণ করিয়া কবির হৃদয়ের ভাব বাহিরে আজ সুন্দরভাবে ফুটাইয়া তুলিয়াছিলেন। প্রকৃতই অভিনয় বড়ই মনোমুগ্ধকর হইয়াছিল।”
তবে সেদিনের আর আজকের সময়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে বেড়েছে ফেক নিউজের রমরমাও। তাই বর্তমান সময়কে বলা যেতেই পারে ‘ফেক নিউজ’ বা ‘ভুয়ো খবরেরর’ যুগও। মজার ছলে তৈরি ফেক নিউজের ভিড়ে বেড়ে চলেছে হ্যাকারদের কার্যকলাপও। নিত্যদিনের এই ফেক নিউজের ফাঁদে পড়ে নিজের সর্বস্ব হারান বহু সাধারন মানুষ। প্রশাসনের তরফে বিভিন্ন ভাবে সচেতনতা প্রচার করা হচ্ছে। কারণ সাধারণ মানুষের সচেতনতার মাধ্যমেই এই সামাজিক ব্যাধি নির্মূল করতে।
Discussion about this post