পঞ্চদশ এবং ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপের বুকে হঠাৎ হানা দেয় এক অদ্ভুত রহস্যময় রোগ। ক্রমে তা মহামারীর আকার ধারণ করে। এই রোগের তেমন কোনো আগাম লক্ষণও ছিল না। রোগের কবলে পড়ে ঘন্টাখানেকের মধ্যে একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের হঠাৎ করেই মৃত্যু ঘটত। মৃত্যুর আগে তার শরীর থেকে অনেক বেশি মাত্রায় ঘাম ঝরে পড়ত। শুধু ঘাম থেকে মৃত্যু ঘটত বলে এই রহস্যজনক মহামারীর নাম হয় ‘ইংরেজ স্বেদন রোগ’। পরে এই রোগ যখন ইংল্যান্ডের বাইরে পা রাখে, তখন থেকে শুধুমাত্র ‘স্বেদন রোগ’ হিসেবে পরিচয় হয় তার। কোনও রকম আগাম আভাস ছাড়া হঠাৎই হানা দিত সে। আর মুহূর্তের মধ্যেই মানুষের মৃত্যু ঘটয়ে উধাও হয়ে যেত!
বিভিন্ন ঐতিহাসিক পান্ডুলিপি ঘেঁটে এই রোগের সম্ভাব্য লক্ষণ সম্পর্কে জানা যায়। এই রোগের মোট তিনটি পর্ব ছিল। রোগের শুরুতেই সাধারণতঃ কাঁপুনি দেওয়া জ্বর হত রোগীর। তার সঙ্গে অনেকের পেশিতে অসহ্য যন্ত্রণাও শুরু হত। শরীর ভীষণই দূর্বল হয়ে পড়ত। এই পর্ব মোটামুটি তিরিশ মিনিট থেকে দু ঘন্টা পর্যন্ত থাকত। একে বলা হত ‘শীতল পর্ব’। এর পর আসত ‘উষ্ণ পর্ব’। এক্ষেত্রে ঘন ঘন ঘাম নির্গত হত তাই তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠত মানুষ। এরপরই শুরু হত ‘চূড়ান্ত পর্ব’। এই পর্বে রোগী ঘন ঘন অজ্ঞান হয়ে পড়তেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই জ্ঞান আর ফিরে আসেনি। তবে রোগী যদি পুরো একদিনের ধকল কাটিয়ে উঠতে পারতেন, তাহলে তাঁর সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা যেত। তবে সবথেকে ভয়ের ব্যাপার ছিল এই যে, এই রোগ থেকে আক্রান্তের মৃত্যু ঘটত খুবই দ্রুত। এবং আশেপাশের মানুষজনের মধ্যে সংক্রামিত ও হয়ে যেত। এভাবেই মহামারীটি সারা ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
ইতিহাসবিদ এডওয়ার্ড হলের ডায়েরি ঘেঁটে এই মহামারী সম্পর্কিত এক অদ্ভুত তথ্য জানা যায়। একমাত্র ইউরোপের ধনী ব্যক্তিরাই এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিল মধ্যবয়সী বা যুবকশ্রেণীর মানুষ। রাজা সপ্তম হেনরীর স্ত্রী অ্যান বলেইনও ছিলেন তাদের মধ্যে একজন। কিন্তু তিনি সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। তবে ইউরোপের অন্যান্য ধনী ব্যক্তিরা এই রোগের ভয়ে দেশ ছেড়ে পালাতেও শুরু করেন। তবে মজার কথা এই যে, ব্রিটিশ দীপপুঞ্জের আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও ওয়েলসের কেউ কিন্তু এই রোগে আক্রান্ত হননি। এমনকি বৃদ্ধ ও শিশুরাও এই রোগের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছিল।
এই রোগটির জন্য দায়ী কি বা কে, তা এখনও জানা যায় না। তখনকার দিনে এত উন্নত প্রযুক্তি ব্যবস্থা ছিল না। জ্ঞানও ছিল সীমিত। তাই বিশেষজ্ঞরা বহু চেষ্টা করেও এই মহামারীর কারণ খুঁজে পাননি। তবে আধুনিককালের বিজ্ঞানীদের মতে হান্টা ভাইরাসের ফলেই হয়ত এই রোগটির উৎপত্তি হয়। এই ভাইরাসটি ইঁদুর জাতীয় প্রানীর মাধ্যমে মানুষের দেহে ছড়িয়ে পড়ত। হান্টা ভাইরাসের প্রভাবে স্বেদন বালাই এর মতই জ্বর, সর্দি ও পেশিতে ব্যথা অনুভূত হয়। তাই বিজ্ঞানীদের একপক্ষের ধারনা, হান্টা ভাইরাসই স্বেদন বালাইয়ের একমাত্র কারণ। আবার কিছু কিছু বিজ্ঞানীদের মতে মাছি ঘটিত আরবো ভাইরাসও সন্দেহের তালিকায় ঢুকে পড়ে। তবে এর আসল কারণের ব্যাপারে জানতে গেলে বিজ্ঞানীদের আরও তথ্যের প্রয়োজন। যেটি আজ আর মজুত নেই। তাই স্বেদন বালাইয়ের আসল কারণ আজও অজানাই থেকে গিয়েছে।
চিত্র ঋণ – De Agostini, IMDB,
Discussion about this post