৮/২ ভবানী দত্ত লেন, প্রেসিডেন্সির পিছন দিকটায়- ঠিকানাটা আজ অল্প বিস্তর সবারই জানা। তবে এই ঠিকানা নবীন প্রজন্মের কাছে একটা খুব ভালো বাঙালি খাবার দোকান হিসাবে। তবে মধ্যবয়স্ক বা একটু বৃদ্ধ মানুষ বিশেষ করে কলকাতাবাসীর কাছে এটা এক আবেগ আর প্রেসিডেন্সীর প্রাক্তনীদের কাছে এই ঠিকানা…থাক আর নাই বা বললাম। প্রায় এক শতকের পুরনো এক রেস্তোরাঁ এটি যাকে নিয়ে কথা বলছি। কলকাতার বুকে এমন বহু পুরনো রেস্তোরাঁ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কিন্তু হঠাৎ এই ‘স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেল’ নিয়েই পড়লাম কেন? কারণ বহু বছর ধরে স্বাধীনতা সংগ্রামের বহু ইতিহাস বুকে নিয়ে বেঁচে আছে এই দোকান।
নেতাজি সুভাষ, চিত্তরঞ্জন দাশ, অরবিন্দ সহ বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী নিত্য দিনের খদ্দের ছিলেন এই দোকানের। এত কথা বলতে বলতে দোকানের মালিকের কথাই বলতে ভুলে গিয়েছি। ১৯১০ সালে চার পাঁচ বছর বয়সী ভাই প্রহ্লাদচন্দ্র পণ্ডাকে নিয়ে দাদা মনগোবিন্দ পণ্ডা ওড়িশা থেকে চলে আসেন কলকাতায়। তাঁদের চোখে তখন একরাশ স্বপ্ন, একটা খাবারের দোকান খুলে মানুষের মুখে দু’মুঠো অন্ন তুলে দেবেন। যা যৎসামান্য আয় হবে তাতেই তিনি খুশি, খাবার নিয়ে তিনি ব্যাবসা করতে পারবেন না। কলকাতায় এসে জায়গাও পেলেন প্রেসিডেন্সির পিছনের দিকটায়, জায়গা দিল মুসলিম পরিবার। শুরু করলেন মানুষের সেবার কাজ। অল্পদিনের মধ্যেই খুবই জনপ্রিয় হয়ে গেল তাঁর এই হোটেল। নাম দিলেন ‘হিন্দু হোটেল’। মাত্র এক আনায় দু’বেলা পেট ভরে মাছ ভাত। এমনকি ট্যাঁকে যদি টাকা নাও থাকে কুছ পরোয়া নেহি, কেউ না খেয়ে ফিরতেন না তার এই হোটেল থেকে।
সাধারণ মানুষের সাথে সাথে আস্তে আস্তে বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীরাও সেখানে আসতেন খাওয়া দাওয়া করতে। ধীরে ধীরে শুধু যে খাওয়াদাওয়া তা নয় বহু গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রামীক আলোচনা-বৈঠকের আস্তানা হতে শুরু করল এই দোকান। এরই মধ্যে দেখা দিল দুর্ভিক্ষ। বাংলায় চারিদিকে অন্নের জন্য হাহাকার। নানা মারণ ব্যাধিতে মারা যাচ্ছে শয়ে শয়ে মানুষ। চুপ করে থাকতে পারলেন না মনগোবিন্দ বাবু। ভাই প্রহ্লাদকে নিয়ে চালে ডালে মিশিয়ে খিচুড়ি রাঁধতে শুরু করলেন আর শত-সহস্র মানুষকে খাওয়াতে থাকলেন। এভাবেই ব্যবসার কথা না ভেবে মনুষ্যত্বের হাত ধরেই দুই ভাই সব বাধায় ঝাঁপিয়ে পড়তে থাকলেন।
দেখতে দেখতে এসে গেল সেই বহু কাঙ্খিত দিন। ১৯৪৭ এর ১৪ আগস্ট মধ্যরাত। ভারত স্বাধীন ঘোষিত হলো। সবার সাথে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়লেন দুই ভাই। নিজের হোটেলের সামনেই পতাকা উত্তোলন করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে উপস্থিত হলেন কিছু সেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্য। উদাত্ত কণ্ঠে চিৎকার করলেন সবাই ‘বন্দে মাতরম’।
এর পরই হোটেলের নাম পাল্টে করা হল ‘স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেল’। আজও প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবসের দিন পতাকা তোলা হয় হোটেলের সামনেই। আজও কোনও বিপদ হলেই এই হোটেলের পাশে এসে দাঁড়ায় ওই মুসলিম পরিবারের সদস্যরা। এভাবেই জাতি ধর্ম সব মিলে মিশে একাকার করে মহীরুহের মতো দাঁড়িয়ে আছে এই হোটেল। অনেক আবেগ,অনেক স্মৃতি, অনেক ইতিহাস বুকে বয়ে নিয়ে চলছে আজও, নির্দ্বিধায়।
তথ্য ও ছবি ঋণ – রামকমল হালদার
Discussion about this post