এই নারীর জীবন এক বিস্ময়কর কাহিনী যেন! সঙ্গীতের প্রতি তাঁর নিবেদন, আত্মনিয়োগ এবং নিভৃত সাধনার মধ্যে তাঁর ছিল এক ধরনের আধ্যাত্মিকতা। তিনি যেন সঙ্গীতকে শুধুই পারফরম্যান্স নয়, বরং কোনো পরম শক্তির কাছে একান্ত নিবেদন হিসেবে দেখেছিলেন। ওস্তাদ আলি আকবর খান একসময় স্বীকার করেছিলেন যে, এই নারীর মত সঙ্গীত প্রতিভা তাঁদের সবার তুলনায় অনেক উচ্চতর। তিনি সেতার বাদক অন্নপূর্ণা দেবী। জন্মের নাম ছিল রোশনারা খান। আলাউদ্দিন খানের কন্যা, আলি আকবর খানের আপন বোন।
জন্ম ১৯২৭ এর ১৭ এপ্রিল। অন্নপূর্ণা নাম দিয়েছিলেন মাইহার এস্টেটের মহারাজা ব্রিজনাথ সিং। তাঁর জীবন ছিল অন্তর্লীন সাধনার প্রতীক, যেখানে খ্যাতির মোহ, সামাজিক স্বীকৃতি বা বাহ্যিক প্রশংসার কোনও স্থান ছিল না। নিখিল ব্যানার্জি, হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার মত শিল্পীদের শিক্ষক ছিলেন তিনি। তাঁর ঠাকুরদা ছিলেন তানসেনের শেষ বংশধর। ফলে সঙ্গীত বইছিল রক্তে। সেই অন্তঃসলিলা ধারার প্রতিই তিনি ছিলেন আত্মনিমগ্ন।
সুরবাহার তাঁর কাছে শুধুমাত্র একটি যন্ত্র ছিল না, ছিল তাঁর আত্মার প্রকাশ। গভীর রাত্রির নৈঃশব্দে সেই সুরবাহার যেন ঈশ্বরের সঙ্গে তাঁর নিরব আলাপচারিতা। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার মতো বিশ্ববিখ্যাত শিল্পীরা থাকলেও, অন্নপূর্ণা দেবী নিজে কখনো নিজের সৃষ্টি বা প্রতিভার প্রচার করেননি। নিজের সঙ্গীতের সম্পদ বিতরণ করে গেছেন তাঁর ছাত্রদের মধ্যে, যেন সঙ্গীতের ধারাবাহিকতাই তাঁর পরম সাধনা ছিল। বিশ শতকে তিনিই একমাত্র নারী সুরবাহার বাদক ছিলেন।
তাঁর এই নিভৃত সাধনার জীবন আজকের প্রজন্মের কাছে এক গভীর বার্তা বহন করে। মহৎ শিল্পকে পাওয়া যায় একাগ্রতা, নিষ্ঠা এবং আত্মসমর্পণের মাধ্যমে। অন্নপূর্ণা দেবীর মতো মহান শিল্পীর স্মৃতি শুধুমাত্র তাঁর ছাত্রদের মধ্যে নয়, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ইতিহাসে চিরকাল অমর হয়ে থাকবে। ১৯৭৭ সালে তিনি পদ্মভূষণ লাভ করেন, ১৯৯১ সালে পান সঙ্গীত নাটক একাডেমি পুরস্কার, ১৯৯৯ এ পান দেশিকোত্তম। ২০১৮ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
Discussion about this post