আমফান ঝড়ের আক্রমণ কাটিয়ে দুই সপ্তাহ পার করে দিয়েছেন তাঁরা। একটু একটু করে লড়াইয়ের পথে এগিয়ে যাচ্ছিলেন সুন্দরবনবাসী। ভারতের এই ব – দ্বীপ অঞ্চলের বহু জায়গায় নদী বাঁধ ভেঙে অবস্থা বেশ শোচনীয়। এরই মধ্যে নতুন করে বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াল ভরা কোটাল। কোটালে নদী ও সমুদ্রবক্ষে জলের পরিমাণ যথেষ্ট পরিমাণে বেড়ে যায়। সেই জল আবার নতুন করে ভাসিয়ে দিয়েছে বন্যা কবলিত বেশ কিছু গ্রামকে।
বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় আমফান শুধু তীব্রতাই নয়, ব্যাপ্তির নিরিখেও অত্যন্ত ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল। দক্ষিণবঙ্গ সহ কলকাতা, হাওড়া-মেদিনীপুর ইত্যাদি বহু অঞ্চল ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত। একেই করোনা আক্রমণের কারণে লক ডাউন, কার্যত আর্থিক সমস্যা। তার ওপরে এই ভয়াবহ ঝড় রীতিমতো ত্রাসের সৃষ্টি করেছে। শহরাঞ্চল কিছুটা সামলে উঠতে পারলেও প্রত্যন্ত গ্রাম রীতিমতো সমস্যার সম্মুখীন। বিশেষ করে দুই চব্বিশ পরগনা এবং সুন্দরবন অঞ্চল।
বঙ্গোপসাগর নিকটস্থ সুন্দরবন আয়লা ও বুলবুলের মতো দুটো ঝড় সামলেছে। তার স্মৃতি এখনও পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি এখানকার মানুষ। এরই মধ্যে এল এই বিধ্বংসী ত্রাস। সুন্দরবনে প্রত্যন্ত গ্রামগুলোয় বহু দরিদ্র মানুষের বাস। মূলত কৃষিজীবী অথবা মৎসজীবী তাঁরা। ঝড়ের দাপটে অধিকাংশের কাঁচা বাড়িঘর ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে। প্লাস্টিকের ছাউনি দিয়ে কিছুটা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলেও কোনও পাকাপাকি বন্দোবস্ত তাঁরা করে উঠতে পারেননি।
অন্যদিকে ঝড়ের দাপটে বেশ কিছু অঞ্চলে ভেঙে গেছে নদী বাঁধ। ফলে সমুদ্রের নোনা জল গ্রামে ঢুকে নষ্ট করে দিয়েছে সমস্ত মিষ্টি জলের উৎসকে। নষ্ট হয়ে গেছে সমস্ত মাছ এবং চাষের জমি। সোনাখালীর কৃষক রাকিবুল হাসান জানালেন নোনা জল ঢুকে চাষের জমির গুণমান নষ্ট করে দিয়েছে। এই জমিকে পুনরুদ্ধার করে আগের অবস্থায় ফেরত আনতে তাদের বেশ কিছু বছর সময় লেগে যাবে। একদিকে লকডাউনের কারণে আর্থিক অনটন, অন্যদিকে চাষাবাদের এই ক্ষতি সুন্দরবনের মানুষের জন্য অত্যন্ত ভয়ঙ্কর অভিশাপ। বিশেষ করে ক্ষতিগ্রস্থ পানের চাষ। একটি নষ্ট হওয়া পানের বরজ নতুন করে বানাতে প্রায় পাঁচ বছরের কাছাকাছি সময় লাগবে তাঁদের।
বাঁধ ভাঙনের জন্য বহু জায়গায় বন্যা হয়েছে ইতিমধ্যেই। দক্ষিণ ২৪ পরগনার গোসাবার রাঙাবেলিয়া, উত্তর ২৪ পরগনার মিনাখা ব্লকের মোহনপুর – হরিণহুলা, হাসনাবাদের বেশ কিছু অঞ্চল সাংঘাতিকভাবে বন্যা কবলিত। সব মিলিয়ে প্রায় ৪০ টির বেশি গ্রাম জলের তলায়। বহু জায়গায় বাঁধ মেরামতির কাজ শুরুও হয়েছিল। কিন্তু নতুন করে সমস্যা তৈরি করল পূর্ণিমার ভরা কোটাল।
গত শুক্রবার ছিল পূর্ণিমা। ভরা কোটালের দিন। পূর্ণিমা আর তার পরের প্রায় দু’দিন নদীবক্ষে জলের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ে। ফলে যা হওয়ার ছিল, কার্যতঃ তাই-ই হল। নতুন করে জল ঢুকে আবারও ভাসিয়ে দিল মিনাখাঁ, হাসনাবাদ মতো কিছু অঞ্চল। সামান্য যেটুকু আশার আলো খোঁজার চেষ্টায় ছিলেন গ্রামবাসীরা, তাতেও নতুন করে এল বিপদের জোয়ার। গ্রামবাসীরা আশঙ্কা করছেন এই জল পুরোপুরি নেমে আগের অবস্থায় ফিরতে হয়তো মাস খানেক সময় লেগে যাবে।
স্থানীয় সাইক্লোন সেন্টার, স্কুল বাড়িতেই আশ্রয় নিয়েছেন এই মানুষজন। রয়েছে জলের সমস্যা, খাদ্যের সমস্যা। যদিও অভিযোগ মিলছে না পর্যাপ্ত সরকারি সাহায্য। স্কুল বাড়িগুলোতে একবেলা কোনমতে জুটছে কিছু খাবার। উত্তর চব্বিশ পরগনার বাছরার বাসিন্দা বুলবুল দাস একজন গ্রামীণ স্বাস্থ্য কর্মী। তার নিজের বাড়িও জলের তলায়। নিজের বাড়ির বাইরে খুঁটি পুঁতে কোনও মতে দিন কাটছে তার গোটা পরিবারের। অভিযোগ কোন সরকারী সাহায্য পান নি। পান নি ছাউনি দেওয়ার মতো সামান্য ত্রিপলও। তার স্বামী অর্জুন দাস জানান, লক ডাউনের জন্য কাজকর্ম বন্ধ এতদিন। মাছ, পোলট্রি চাষ শুরু করেছিলেন। বন্যায় সব নষ্ট। এক অজানা আশঙ্কায় ভুগছেন তারা।
মাস খানেক পর জলের স্তর নামলেও নানান রোগ ও সমস্যা থেকেই যাবে বলে জানান বুলবুল। ইতিমধ্যেই তিনি গ্রামের মানুষকে ওষুধের জোগান দিচ্ছেন। কিন্তু খাদ্যের জোগান কীভাবে হবে কেউ জানে না। অন্যদিকে যে অঞ্চলগুলোতে বন্যা হয় নি সেখানেও পুরোপুরি শঙ্কা মুক্ত নন বাসিন্দারা। গ্রামে গ্রামে বাড়ি ভেঙে চুরমার। নতুন করে সবকিছু ঠিক করে উঠতে পারে নি একটা বড়ো অংশ। খুব সামান্য কিছু সাহায্য এসেছে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী মানুষের তরফে। বাসন্তীর এক প্রান্তিক গ্রামের বাসিন্দা ইব্রাহিম জানান চিন্তার বিষয় হল, বৃষ্টি বাদল লেগেই আছে। দক্ষিণবঙ্গে বিক্ষিপ্ত ঝড় বৃষ্টি লেগেই থাকছে। ছাদহীন ঘরে এই সময়ে বাস করা ভীষণ বিপদজনক। বিশেষ করে বাচ্চাদের লেখাপড়ার খুব ক্ষতি হচ্ছে। বইখাতা ভিজে নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকছে। এরকম নানান বিপদের মধ্যে দিয়েই দিন কাটছে সুন্দরবনের। নানান অজানা আশঙ্কা, মানসিক সমস্যা ঘিরে রেখেছে সেখানকার মানুষদের।
Discussion about this post