জাতে সে ছিল এক নামি দামী জার্মান শেফার্ড। শখ করে তার মালিক নিয়ে এসেছিল তাকে। নাম দিয়েছিল ডাস্টিন। আসার পর কিছুদিন বেশ আনন্দেই কাটল তার। বাড়ির মানুষজন তাকে কতই না ভালবাসে! দিনরাত তার সঙ্গেই সময় কাটাত তারা। এমনকি নিজেদের বিছানাতেও তাকে ঠাঁই দিত। কিন্তু যতদিন যেতে থাকল তার প্রতি টান যেন কমতেই থাকল বাড়ির লোকজনের। এমনকি যিনি তাকে শখ করে এই বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন সেই মালিকও আর ঘুরে তাকান না তার দিকে। শেষ পর্যন্ত বাড়ির ছাদেই রেখে আসা হল ডাস্টিনকে।
ছাদ বাড়িকে ছায়া দেয়। ঝড়-বৃষ্টি-রোদ থেকে রক্ষা করে। কিন্তু ডাস্টিনের মাথার উপর কোনও ছায়া ছিল না। ঝড়, বৃষ্টি কিংবা রোদের তাপে বেচারা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। শীতের ঠান্ডা তার গায়ে লাগলে কাপড়ের পুঁটলির মত কুঁকড়ে যেত সে। আবার যখন বৃষ্টি শুরু হত, মাথার উপর এক টুকরো ছাদের জন্য এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে বেড়াত ডাস্টিন। তার মানুষ মালিকরা তার কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। মনে পড়লে কখনও কখনও তাকে দেখতে আসত ছাদে। কোনওদিন তার কথা মনে হলে খাবার পেত সে, মনে না পড়লে সে না খেয়েই দিন কাটত তার। এর মধ্যেই তাকে দিয়ে সন্তানের জন্ম দেওয়ালেন তার মালিকেরা। ডাস্টিন ভেবেছিল এবার অন্ততঃ তার খুদে বাচ্চাদের নিয়ে সময় কেটে যাবে তার। মালিকের তার মনে নাই বা থাকল, তার সন্তানরা অন্তত তার সঙ্গেই থেকে যাবে। কিন্তু কিছুদিন পরই ভুল ভাঙল তার। মাস খানেক পরই তার সন্তানদের বিক্রি করে দেওয়া হল। ডাস্টিন জানে না কোথায় তাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। শুধু জানত ছাদ থেকে নিচের সিঁড়ি দিয়েই ওদের নিয়ে চলে যাওয়া হয়েছে। ফ্যাল ফ্যাল করে সেদিকে তাকিয়ে থাকত সে। মাঝেমধ্যে কারুর দেখা পেলে অসহায়ভাবে চিৎকার করে উঠত সে। সে বলতে চাইত, “আমাকেও প্লিজ এখান থেকে নিয়ে যাও!”
এসবের মধ্যেই ডাস্টিনের জীবনে আনন্দ নিয়ে এসেছিল পাশের ছাদের কিছু মানুষ। তারা তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করত, খেলা করত, এমনকি প্রায়ই তাকে খাবার দাবারও দিত। এই মানুষগুলো তার মালিককে অনেক বুঝিয়েছিল। তাকে যেন একটু যত্নে রাখা হয়, সময়মত খেতে দেওয়া হয়। নাহ, সে কথা রাখেননি তার মালিক। বরং সে দেখেছে তার প্রসঙ্গ উঠলেই মালিক কিরকম যেন এড়িয়ে যেতেন। আস্তে আস্তে সব কিছু অসহ্য হয়ে উঠতে লাগল তার কাছে। আশ্রয়হীন ছাদ যেন নরক হয়ে উঠছিল দিনদিন। মাঝেমাঝে একাই কুঁই কুঁই শব্দ করে কাঁদতে থাকে সে। যদি কেউ আসে! যদি কেউ একটু ভালবাসা দেয় আবার! নাহ, কেউ আসে না। প্রায় পাঁচ বছর ধরে এই একাকীত্ব আর মানসিক কষ্ট নিয়ে দিন কাটায় সে। কিন্তু এবার আর পারছিল না! শেষ মুহূর্তে পাশের ছাদের মানুষগুলির জন্য মনটা খুব বিচলিত হয়ে ওঠে তার। যদি একবার তাদের দেখা পাওয়া যেত! বিদায় জানিয়ে যেতে পারত সে। ৮ আগস্ট ২০১৫, আত্মহত্যা করে ডাস্টিন। সে যে মানুষ নয়, কুকুর বলেই হয়ত তার মানসিক কষ্টের কাহিনী কাউকে জানিয়ে যেতে চায়নি। কিন্তু শেষ মুহূর্তেও সে একটু মানুষের সঙ্গ চেয়েছিল। চেয়েছিল কেউ তাকে শুরুর দিনগুলোর মতই ভালবাসায় ভরিয়ে দিক। নাহ এসব কিছুই পায়নি সে। একরাশ হতাশা আর যন্ত্রণা নিয়ে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে সে।
ডাস্টিনের মৃত্যু আমাদের অচিরেই এক কঠিন শিক্ষা দিয়ে যায়। আমরা যারা ভাবি একটু খাবার আর আশ্রয় দিলেই আমাদের পোষ্যগুলি খুব ভাল আছে তা কিন্তু ভুল। সেই আদিম যুগ থেকেই মানুষের সঙ্গী হিসাবে কুকুরদের বেড়ে উঠা। তাই মানুষের মত তারাও ভালবাসার কাঙাল। তারাও চায় দিনের শেষে আপনার সঙ্গী হতে। আপনার সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাতে। তাও যদি তাকে সঙ্গ বা একটু ভালবাসা দিতে না পারেন, অহেতুক শখের বশে ওদের বাড়িতে নিয়ে আসবেন না। নাহলে কদিন পর আরেকটি ডাস্টিনের মতই তাদের জায়গা হবে বাড়ির ছাদ অথবা কোনও অন্ধকার গ্যারেজে। তখন তার প্রতিটি দীর্ঘশ্বাস ছিন্নভিন্ন করে দেবে তাদের বেঁচে থাকার ইচ্ছেকে।
Discussion about this post