জীর্ণ পুরাতন এক অটো থেকে বাংলাদেশের পরিবহন সংস্থার এক নামজাদা তারকা। নাম শ্যামলী পরিবহন। কম বেশি আমরা অনেকেই চিনি, চড়ে ঘুরেছিও বিভিন্ন জায়গায়। তবে ভাবছেন তো শুরুতে উল্লিখিত অটোর প্রসঙ্গ হঠাৎ কেন এল? তাহলে বলতে হয়, আজকের শ্যামলী পরিবহনের অবস্থানের সঙ্গে নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে এই অটোর। শুধু তাই নয়, শ্যামলী পরিবহনের পরতে পরতে মিশে থাকা অতীত ঘাঁটলে আমরা এই স্কুটারের মালিকের কথাও জানতে পারি। দারিদ্র্যতাকে জয় করে যিনি প্রতিনিয়ত স্বপ্নের বীজ বুনেছেন। তিনি আর কেউ নন, শ্যামলী পরিবহনের চেয়ারম্যান গণেশচন্দ্র ঘোষ। ৪৪ বছর আগে সেই জীর্ণ পুরাতন অটো চালক গণেশচন্দ্র ঘোষ একটি চকচকে নতুন বাস কেনার স্বপ্ন দেখেছিলেন। পূরণও করেছেন নিজ প্রচেষ্টায়। পাবনা জেলার অভাবী ঘরের এই গণেশচন্দ্র ঘোষ আজ গোটা দেশের পরিবহন খাতের দিকপাল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। তার সেই জীর্ণ অটোটি যেন এক চারাগাছ, যা এখন মহীরুহে পরিণত হয়েছে।
শ্যামলী পরিবহন প্রাইভেট লিমিটেড আজ বাংলাদেশের বিলাসবহুল বাস পরিবহনের শীর্ষস্থান দখল করেছে। এখন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও পৌঁছে যায় তিল তিল করে গড়ে তোলা এই প্রতিষ্ঠানের বাস। ঢাকার শ্যামলী স্কোয়ারের কাছেই পরিবহণের কার্যালয়। কিন্তু এই যাত্রাপথটা শুরু থেকেই খুব একটা মসৃণ ছিল না। ১৯৭২ সালের কথা। তখন বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ পেরিয়ে সদ্য একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। যুদ্ধের পরবর্তীতে জীবন চালানোও ছিল আরেক সংগ্রাম। গণেশ চন্দ্র ঘোষের পরিবারেও ছিল শতেক রকমের অভাব-অনটন। সেইসময়ই জ্যেষ্ঠপুত্র হিসেবে পরিবারের হাল ধরতে তিন চাকার একটি অটো কিনে ফেলেন তিনি। এর মধ্যেও স্বপ্নবান মানুষটি পড়াশোনা ছাড়েননি। নিজে চালক হিসেবে ক্লাসের ফাঁকে বাণিজ্যিকভাবে যাত্রীদের পরিষেবা দিতে শুরু করেন পাবনা-সুজানগরের রাস্তায়।
তবে নিজস্ব বাস কেনার এবং ব্যবসা চালু করার স্বপ্নের হাতছানিতে মশগুল ছিলেন তিনি সদাই। অন্যের কাছে তার এই স্বপ্ন হাসির খোরাক হলেও আত্মবিশ্বাস হারাননি কখনো। অটো চালিয়ে উপার্জিত অর্থ থেকে কিছুটা সঞ্চয় করতে শুরু করেছিলেন স্বপ্নবান লোকটি। সংসারের ঘানি টানতে টানতেই একসময় পাবনা জেলার এডওয়ার্ড কলেজ থেকে রসায়নে সাম্মানিক ডিগ্রি অর্জন করে ফেলেন। আকাশছোঁয়া স্বপ্নের বাস্তবায়নে তিনি পাশে পেয়েছিলেন তার দুই ভাইকে। আজকে শ্যামলী পরিবহনের সাফল্যে তার দুই ভাইয়ের অবদানও অনস্বীকার্য। নিয়মিত অটো চালিয়ে তাদের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে আরও কয়েকটি অটোর মালিক হয়ে গেলেন তারা। আর এভাবেই শুরু হল শ্যামলী পরিবহনের পথচলা। ‘শ্যামলী পরিবহন’ এই নামটি প্রথম লেখা হয়েছিল প্রথম কেনা সেকেন্ড হ্যান্ড, জীর্ণ শীর্ণ স্কুটারটির গায়ে। এখন দেশে-বিদেশে গৌরব বহন করছে সেই নাম।
এখানেই শেষ নয়। সব অটোগুলিকে বিক্রি করেও নতুন বাস কেনার স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেছিল গণেশ চন্দ্রের। ১৯৭৪ সালে পুরনো একটি বাস কিনে উপার্জনের পথ কিছুটা প্রশস্ত করেছিলেন তিনি। তবে স্বপ্নকে তো ছুঁতেই হবে! পুরনো বাস চালিয়ে প্রাপ্ত অর্থ, বাড়ির মহিলাদের স্বর্ণালঙ্কার বিক্রির অর্থ এবং কিছু ঋণের মাধ্যমে ১৯৭৮ সালে অবশেষে নতুন ঝাঁ চকচকে একটি বাস কেনেন গণেশ চন্দ্র ঘোষ। তখন থেকেই তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক বাস কিনে পরিবহণের ব্যবসাটিকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বাংলাদেশের ১৬টি জেলায় শ্যামলী পরিবহনের বাস চলাচল করে। আন্তর্জাতিক যাত্রাপথের মধ্যে রয়েছে ঢাকা-কলকাতা, আগরতলা-ঢাকা, ঢাকা-শিলং-গুয়াহাটি-ঢাকা, চট্টগ্রাম-ঢাকা-কলকাতা রুট।
ব্যবসায় নামার পর ৫০ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। ব্যবসার পাশাপাশি একসময় পাবনার শহীদ বুলবুল কলেজে রসায়ন বিষয়ে অধ্যাপনাও করেছেন গণেশচন্দ্র। ২০০৯ সালে সেখান থেকে অবসর নিয়েছেন। সময় বদলালেও লোভ-লালসার সামান্যতম আঁচও নিজের কাছে আসতে দেননি গণেশচন্দ্র। যাত্রী সেবাই তার কাছে বড় কথা। অথচ জীবনের সমস্ত সংকীর্ণতাকে জয় করে তিনি এখন দেশের গুরুত্বপূর্ণ পরিবহণ খাতের সার্থক এক ব্যবসায়ী। তার শ্রম, মেধা ও কঠোর পরিশ্রম নতুন প্রজন্মের ব্যবসায়ী উদ্যোক্তাদের জন্য প্রেরণা হয়ে থাকবে।
Discussion about this post