সুভাষচন্দ্র বসু বাঙালির কাছে শুধুই এক স্বাধীনতা সংগ্রামী যোদ্ধা নন। বাঙালির প্রতি রন্ধ্রের আবেগে জড়িয়ে তিনি। তাঁর দৃপ্ত সেই চাউনিতে আজও একজোট হতে পারে সমগ্র বাংলার মানুষ। তবে স্বাধীন ভারতে তাঁর অনুপস্থিতির রহস্যটা নিয়ে কৌতুহলের দাঁড়িপাল্লাটা ভারী হয়েছে ক্রমশ। কিন্তু হাজার জানা অজানার মাঝেও নেতাজীর বলিষ্ঠতার ছাপটা হারিয়ে যায়নি কখনোই। ইতিহাসের হলদে পাতায় নিঃশব্দে শ্বাস ফেলছে আজও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালের রক্তক্ষয়ী সেই দিনগুলো।
দেশের স্বাধীনতা আনতে অক্ষশক্তির সাথে হাত মেলালেন নেতাজী। পৌঁছে গেলেন জার্মানি৷ কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি একরকম অসাড় দশায় ফিরল। সুভাষ তাই দেশে ফেরাটাই নিরাপদ বুঝলেন। কিন্তু বিমানে প্রকাশ্যে যাওয়াটা খুবই ঝুঁকির। কারণ মিত্রশক্তি তখনও নেতাজীর সন্ধানে সজাগ। তাই সাবমেরিনই একমাত্র আস্থা। এদিকে ইংলিশ চ্যানেল, উত্তর সাগর, ভূমধ্যসাগর, আটলান্টিক মহাসাগর- সবকিছুই এখন মিত্রবাহিনীর দখলে। তার উপর সমুদ্রতলে ফাঁদ পাতা সব মাইনের আতঙ্ক। একটু এদিক ওদিক হলেই সব শেষ। অতিরিক্ত সতর্কতা ছাড়া আর কোনো অস্ত্রই তখন নেই। নেতাজী তাই করলেন এক সিক্রেট প্ল্যান। তাঁর যাত্রাপথ নিরাপদ করতে তাঁর ভাষণের রেকর্ড আজাদ হিন্দ রেডিও থেকে পরে সম্প্রচার হবে। তাতে মিত্রশক্তির নজরে পড়বে নেতাজীর অবস্থান জার্মানির মাটিতে। কিন্তু আসলে নেতাজী তখন ফিরছেন সমুদ্রের গভীর তলদেশ দিয়ে দেশের পথে। সঙ্গী হিসেবে বেছে নিলেন হায়দ্রাবাদের তরুণ এক ছাত্র আবিদ হাসানকে।
৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩। জার্মানির কিল নৌ বন্দর। U-180 তে উঠলেন নেতাজী। ডিজেল চালিত সাবমেরিন। সাবমেরিনটি আবার ৪৮ ঘন্টার পরই চার্জ ফুরিয়ে ভেসে ওঠে সমুদ্রের ওপরতলে। তখনই শত্রুপক্ষের নজরে আসার এক আশঙ্কা ঘিরে ধরে সাবমেরিনের মধ্যে থাকা সব্বাইকে। কিন্তু নেতাজীর চোখে কখনও ভয়ের ছাপ দেখেনি তাঁর সাথীরা। ব্যাটল শিপ, ডেস্ট্রয়ার, ক্রুজার বিমান বহর, ডেপথচার্জ, টর্পেডোর নিশানা তখনও ওৎ পেতে বসে। নেতাজীর খবর পেলেই চলবে ব্রিটিশশক্তির কামান গোলা। গোটা সমুদ্রতীর জুড়ে রয়েছে ডুবন্ত মাইনের জাল পাতা। ক্যাপ্টেন মুসেমবার্গের বিনিদ্র চোখে একটাই লক্ষ্য নেতাজীকে সুস্থভাবে উপকূলে ফিরিয়ে দেওয়া।
ফেব্রুয়ারি পেরিয়ে মার্চ। সাবমেরিনের ছোট্ট কেবিন। যার মধ্যে দাঁড়াবার জায়গাটুকুও নেই। সারাদিন একনাগাড়ে বসে থাকার সে কি বীভৎস যন্ত্রনা। দিনে তিন-চার ঘন্টার বেশি ঘুমটাও ছিলনা নেতাজীর চোখে। পর্যাপ্ত খাওয়ারও একরকম শেষের দিকে। নেতাজী তখনও বলিষ্ঠভাবে জার্মান নৌ বিভাগের পোশাকে বসে। মুখটা ছদ্মবেশের দাড়িতে ঢাকা পড়েছে। শরীরের ওজনও দিনে দিনে কমছে। কিন্তু নেতাজীর সেসবে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। তখন তিনি পরবর্তী পরিকল্পনার খুঁটিনাটিতে ব্যস্ত। উদ্দাম জাতীয়তাবাদের বক্তৃতার খসড়াটা বানিয়ে ফেলছেন এক মনোযোগে। নারীবাহিনীর সুবিধা অসুবিধার চিন্তাও ঘিরেছে তাঁর মস্তিষ্ককে।
সাবমেরিন তখন আটলান্টিক মহাসাগরে। হঠাৎ সতর্কতাবার্তা, “হ্যালো! হ্যালো! ডাইভ! ডাইভ! পানির চাপ দেখে মনে হয়, কাছে কোথাও ডেস্ট্রয়ার ঘুরে বেড়াচ্ছে।” সাবমেরিনকে আরও গভীর সমুদ্রতলে নিয়ে যাওয়া হল। শত্রুপক্ষের একটি ডেস্ট্রয়ার থেকে মুক্তি পেলেন তাঁরা। এমনই হাজার হাজার উৎকন্ঠার মধ্য দিয়ে সাবমেরিনটি এগিয়ে চলে। সবার মধ্যেই এক চরম আশঙ্কা, মৃত্যুভয়ের টানটানি। একমাত্র নেতাজীই তাঁর কাজে অটল। এমনকি কেউ অন্যমনস্ক হলে তাকে ধমকও দিয়ে চলেছেন।
চোখের একদম সামনে এবার শত্রুপক্ষ হাজির। কন্ট্রোল রুমের ছোট্ট ভুলেই ভেসে উঠল সাবমেরিন ওপরে। ধাঁ করে ছুটে এল বিপক্ষের ফাইটার জাহাজ। কাত হয়ে গেল সাবমেরিনটি। মৃত্যু প্রায় চোখের সামনে তখন। ধাক্কা লেগে ব্রিজের একাংশ গেল ভেঙে। কোনোরকমে আবার ডুব দিল সাবমেরিন আর অদৃশ্য হল চোখের পলকেই। এমন এক মারাত্মক বিপদ থেকে মুক্তি পেয়েও নেতাজীর দীর্ঘশ্বাসটুকুও পড়ল না। তিনি লেগে পড়লেন তাঁর ফেলে রাখা কাজটায়। তাঁর উক্তিতে ছিল শুধুই এই ভুল থেকে শিক্ষাটুকু নিয়ে ভবিষ্যতে তা সংশোধন করার। যেন এক আবেগহীন কঠোর ভাবমূর্তি।
টানা দু’মাস পর মাদাগাস্কারের উপকূল। জাপানের সংকেত মিলল। পরিকল্পনামাফিক এরপরে নেতাজীর দায়িত্ব জাপান সরকারের। জাপানি সাবমেরিন I-29 ভেসে উঠল ঢেউ ভেঙে এবং নেতাজীকে নিয়ে ফের ডুব দিল। এই পর্ব শেষেই দেশের মাটির ডাক। যদিও বিপদের বড় ফাঁড়া কেটেছে অনেকটাই। আনন্দের হাসির রেখা তখন ফুটেছে নেতাজীর ঐ গুরুগম্ভীর মুখটায়। এ হয়ত ছিল দেশের টানের আনন্দটা যেটা সুদূর ইউরোপে অনুভব করেননি এতকাল। এই সাবমেরিনে গোটা একটা মাস লেগে গেল দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার শক্ত মাটি পেতে। নেতাজীর চোখে তখন ভবিষ্যতের আরও আশা দৃঢ় হয়ে উঠছিল। মনের আর মুখের ভাবে ছিল সাহস আর অদম্য একাগ্রতার ছাপ।
Discussion about this post