এই গল্পটা বলতে গিয়ে এত কথা চলে আসছে মনে। যে বুঝতে পারছি না কোথা থেকে শুরু করবো আর কোথায় শেষ? আসলে ডিপ্রেশন। একটা গভীর ডিপ্রেশন, হতাশা। আর ডিপ্রেসেড মানুষরা হয় বেশি বকে, অথবা একবারে চুপ। যাই হোক, যেটা বলছিলাম, একটা রেল লাইনের গল্প। এই রেল লাইনটা দেখা যায় ডুয়ার্সে। শিলিগুড়ি থেকে আলিপুর দুয়ার ১৬৮ কিলোমিটার। এ এক স্বপ্নের রেলযাত্রা। একদিকে পাহাড়কে রেখে জঙ্গল আর চা বাগানের মধ্যে দিয়ে চলছে ট্রেন। তিন তিনটে বড় বড় ন্যাশনাল পার্কের একেবারে ভেতর দিয়ে চলে যাচ্ছে এই রেল। মহানন্দা, চাপরামারী, আর বক্সা। আমার জানা নেই, আর কোথাও একটা রেললাইন তিনটে ন্যাশনাল পার্কের হৃদয় চিরে এভাবে যায় কিনা। ব্রিটিশ আমলে তৈরি এই লাইন, চলতো ছোট্ট খেলনা রেল। নিয়ে যেত কাঠ, চা পাতা। কয়লার ইঞ্জিন, ধক ধক করে ধীরে ধীরে চলতো। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে পড়তো। কারণ সামনে হাতির পাল। হাতিরও তাড়া নেই, রেলেরও তাড়া নেই।
লাইন বড় হল, রেলও বড়ো হলো। এখন চলে অনেকগুলো এক্সপ্রেস ট্রেন এবং মালগাড়ি। দুরন্ত গতিতে ছুটে চলে যায় ট্রেনগুলো তীব্র হুইসেল বাজিয়ে, দশ দিক কাঁপিয়ে। আসলে এটা একটা খুনি রেললাইন। এর প্রতি চাকায় রক্তের দাগ। এখনো পর্যন্ত ২৫০ টিরও বেশি হাতি, বাইসন, লেপার্ড, হরিণ আরও কত ছোট প্রাণীকে পিষে দিয়ে চলে গেছে ট্রেন। কত রক্ত লাগা এই লাইনে, কত প্রাণীর কত সুখী পরিবার নষ্ট হয়ে গিয়েছে এখানে। এমনও হয়েছে যে একসাথে ৭ টি হাতিকে পিষে দিয়ে চলে গিয়েছে ট্রেন। টুরিস্ট তুমি যখন এই ট্রেনে বসে ডুয়ার্সের রূপ উপভোগ করো, তখন কি শুনতে পাও? জঙ্গলের কান্না, ব্যথা। কী তুলনা দেব জানিনা। ধরা যাক ভিড়ে ঠাসা ধর্মতলার রাস্তায় যদি কেউ হঠাৎ করে একটা বুলডোজার চালিয়ে দেয়? গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এই রেললাইনটাও আসলে ঠিক তাই।
আজ একটা বিশেষ দিন। মাস দুই আগে সে নেমেছিল চালসার কাছে এই চা বাগানের এক প্রান্তে। নেমেছিল একটা নালার মধ্যে, ছানা পাড়তে। সে একটা মা চিতা। কী সুন্দর আর মিষ্টি হয়েছে ছানা দুটো। এখানে বেশ নিশ্চিন্তে থাকা যায়। রাত্তিরে বেরিয়ে শ্রমিক বস্তি থেকে এক-আধটা মুরগি ধরে নিলেই হলো, ব্যাস। মানুষগুলো এদিকটা বড় একটা আসে না। কিন্তু এবার ছানাগুলোকে এখান থেকে সরাতে হবে। ছানাগুলো একটু বড় হয়েছে। এখনও অনেক কাজ বাকি। ওদের শেখাতে হবে চলাফেরার কায়দা, শিকার ধরা, কোথায় জল পাওয়া যায়। চেনাতে হবে জঙ্গলটা, আরো কত কিছু। জঙ্গলের অনেক বিপদ। এক বছর চলবে মায়ের এই ইস্কুল।
আজই সেই দিন। শীতের বিকেল, সন্ধে হয়ে আসছে। এখনই সরাতে হবে। নিয়ে যেতে হবে ওই রেললাইনটা পেরিয়ে, পিছন দিকের পাহাড়টার গায়ে গভীর জঙ্গলের দিকে। জঙ্গলে অনেক বিপদ, রাতে কয়েকদিন ছানাগুলোকে একলা রাখা যাবে না। নাঃ, আর দেরি নয়। মা চিতা একটাকে ঘাড় কামড়ে ধরলো, দিলো একছুট। ঝোপঝাড় পেরিয়ে ছুটতে ছুটতে রেল লাইন টপকে, ঢুকে পড়ল জঙ্গলের মধ্যে। রেখে দিল ঝোপের মধ্যে, একটু পাতা দিয়ে ঢেকে ঢুকে। আবার দিল ছুট, আর একটাকে আনতে হবে। মনের মধ্যে খুব টেনশন, দুই দিকে দুই ছানা একা। খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে। হঠাৎই, কানে এলো সেই আওয়াজটা। সেই দৈত্যটা, রোজ অনেকবার যায়। কী বিকট আওয়াজ, মাথার উপর একটা বিরাট চোখ জ্বালিয়ে, ফোঁস ফোঁস করতে করতে চলে যায়। হাত-পা অবশ হয়ে যায়, বুকটা ধড়ফড় করতে থাকে। কোথায় পালাবে সে ভেবে পায় না। ওপাশে ছানাটা একা রয়েছে, থামা যাবে না। সে ছুটেই চলে, উঠে পড়ে লাইনে। আলগা পাথরে পা-টা পিছলে যায়। বুকটা এমন ধড়ফড় করছে যে, যেন হৃদয় বন্ধ হয়ে যাবে। একটা মুহূর্তের ভুল, ঘাড়ের উপর এসে পড়ে ডাউন কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস। সে পড়ে থাকে লাইনে। ওপর দিয়ে তীব্র হুইসেল বাজিয়ে ধীরে ধীরে জঙ্গলের বাঁকে হারিয়ে যায় ট্রেনটা।
তার চোখে তখন পৃথিবীর আলো নিভে যাচ্ছে, চারদিক বড্ড অন্ধকার লাগছে। দু’দিকে দুটো ছানা অপেক্ষা করছে মায়ের জন্য। ডুয়ার্সে সন্ধে নামছে, খুব নরম সন্ধ্যে নামে এখানে পাহাড়, জঙ্গল, বাগানের মধ্যে। জঙ্গলের পাশের রিসোর্টগুলোতে আলো জ্বলে উঠছে। বার্বি কিউ পার্টি হবে, জোরালো মিউজিক বাজবে, হবে, নাচ হবে। ওদিকে ছানাগুলো মায়ের অপেক্ষায় থাকবে, অনেকক্ষণ হয়ে গেল। খুব ভয় করছে, মা ছাড়া দুনিয়াতে কিছুই দেখে নি, জানে না, চেনে না । গলা ফেটে কান্না বেরিয়ে আসছে। মা কখন আসবে? বার্বি কিউ পার্টি এই কান্না কি পৌঁছবে?
দু’দিন বাদে মৃতপ্রায় অবস্থায় উদ্ধার করা ছানা দুটোর জায়গা হল খয়েরবাড়ি রেসকিউ সেন্টারের অনাথ আশ্রমে। বললাম না, এটা আসলে ডুয়ার্সের গল্প নয়। এতি আসলে একটি খুনি রেললাইনের গল্প।
কলমে শুভাশিস নায়েক
Discussion about this post