বছরের শেষলগ্ন। ঠান্ডা বাতাস এখন, শরীরে কাঁটা দিতে শুরু করেছে। কেক-পর্ব চলছে চারিদিকে। চার্চগুলো সেজে উঠছে নতুন সাজে। বড়দিনের মেগা মুহূর্তে সবাই ব্যস্ত তিলোত্তমার প্রাণকেন্দ্র পার্ক স্ট্রিটকে নিয়ে, অথবা ভিড় জমাচ্ছেন মহানগরীর সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালে। ঠিক সেই সময়েই মনে পড়লো মফঃস্বলের ইতিহাসের এক দলিলকে। তবে মফঃস্বল কিন্তু এ বিষয়ে পিছিয়ে নেই একেবারেই বরং এগিয়ে গিয়েছে বলা যায়। এ হল বয়সের ভারে কলকাতার সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালকে টেক্কা দেওয়া শ্রীরামপুরের সেন্ট ওলাভ চার্চ। ২১৪ বছর বয়স হলেও পায়ে একটুও ব্যাথা নেই, দুই শতাব্দী ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে নির্বিকার চিত্তে। কত ইতিহাস যে চার্চের প্রতিটা ইটে জমা রয়েছে।
১৫’শ শতকের শেষ দিক। সমুদ্রপথে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি এসে তখন হুগলিতে বাণিজ্য স্থাপন করছে। পর্তুগিজ, ব্রিটিশ, ফ্রেঞ্চ ও ডাচদের পাশাপাশি উত্তর-পূর্ব ইউরোপের ডেনমার্কও বাংলায় ঘাঁটি গাড়ল। ডেনমার্কের বণিকদল হুগলির শ্রীরামপুরে এসে কুঠি তৈরি করে। প্রায় একশ বছর ধরে তারা এখানে ব্যবসা-বাণিজ্য করে। আজকের আধুনিক শ্রীরামপুর শহরের পত্তন ঘটায় ওরাই। তখন অঞ্চলটি অবশ্য ‘ফ্রেডরিখ নগর’ হিসেবে পরিচিত। ১৭৫৫ সাল। ড্যানিশরা শ্রীরামপুরে থাকতে শুরু করেছে। ১৭৭৬ তে শ্রীরামপুরে ডেনমার্ক থেকে পাঠানো হয় কর্নেল ওলা বি’কে। তিনিই প্রথম এখানে গির্জা তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। শুরু হল অর্থ সংগ্রহ। তৎকালীন মারকুইস অফ ওয়েলেসলি ১০০০ টাকা দান করেন। শ্রীরামপুরের মিশনারিরাও অর্থিক অনুদানও দেন। তারপর ১৮০০ সাল। হুগলি নদীর পশ্চিম তীরে জলা-জঙ্গল সাফ করে শুরু হয় এই গির্জার নির্মাণ পর্ব।
নির্মাণ শেষ হতে সময় লেগেছিল প্রায় পাঁচ বছর। খরচ ১৮,৫০০ টাকার মতো। তখন গির্জাটির নাম ছিল ‘লুথেরান চার্চ’। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় ওলাভের মৃত্যু হল ১৮০৫ সালে। তিনি চার্চের অসমাপ্তির মধ্যেেই বিদায় নিলেন। তাই গভর্নর ক্রেফটিং এর তত্ত্বাবধায়নে ১৮০৬ এ নির্মানকাজ শেষ হল। পরে ওলাভের স্বপ্নের গির্জাকে নরওয়ের ‘সেন্ট ওলাভ’ সন্তের নামে রাখা হয়। এর সুউচ্চ চূড়াটি শ্রীরামপুরের ওপর পাড়ে ব্যারাপুরের গভর্নরের লাটবাগান থেকেও দেখা যেত। ব্যাপটিস্ট মিশনারি উইলিয়াম কেরি প্রথম এখানে উপাসনার দায়িত্ব নিলেন। স্থপতিবিদদের মতে, এই চার্চে ডেনিশ অপেক্ষা ব্রিটিশ কারুকার্য বেশি।
তারপর শুরু হল ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক একাধিপত্য। দিনেমারদের উৎখাত করা হল শ্রীরামপুর থেকে। তখন এটির দায়িত্বভার নিলেন কলকাতার বিশপ। গির্জার সামনেই একটি বাগান ছিল। সেখানে কিছু কামান এখনও সংরক্ষিত করে রাখা। বর্তমানে গির্জাটিকে সুন্দর করে সাজিয়ে দৃষ্টিনন্দন করে তোলা হয়েছে। বেশ কিছু আন্তর্জাতিক পুরস্কারের পালক লেগেছে এই চার্চের মাথায়। ২১২ বছরের প্রাচীন এই গির্জার ঐতিহ্য অপরিসীম। বড়দিনের সময়ে আলোর মালায় সেজে ওঠে শ্রীরামপুরের চার্চ চত্ত্বর। প্রতিবারের মতো এবারেও সে আলোর মালায় সেজে উঠেছে। মধ্যরাতে গির্জার ঘণ্টা বাজার পর আরও একবার সে তার মতো করে খুঁজে নিলো তাৎপর্য।
Discussion about this post