“শেষে একদিন স্যারের নোংরা হাতটা
মোচড়ে দিয়েছে দুর্গা, মেরেছে ঝাপটা!
ওরে অর্ধেক আকাশে মাটিতে শ্যাওলা
আকাশে উড়বে, হবে কল্পনা চাওলা।
যদি না বিমান ভেঙে পড়ে তার দুদ্দাড়
মহাকাশচারী হবেই বটেক দুর্গা।”
মল্লিকা সেনগুপ্তের কন্যাশ্লোক কবিতায় দুর্গা সোরেনের স্বপ্ন শেষ অবধি সফল হয়েছিল কিনা জানা যায় নি। তবে, আমাদের দেশে অধিকাংশ কন্যার জীবনেই স্বপ্নের বিমানটি যে মাঝপথে মুখ থুবড়ে পড়ে এ কথা আমাদের সকলেরই জানা। এই মেয়েদেরই একজন চণ্ডীগড়ের রুচিকা গিরহোত্রা। ১৯৯০ সালে ১৪ বছরের উঠতি টেনিস তারকা রুচিকা গিরহোত্রা এসপিএস রাঠোরের হাতে যৌন হেনস্তার শিকার হয়। রুচিকার পরিবার এসপিএস রাঠোরের মতো প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন। এর ফল হিসেবে, রুচিকাকে তৎক্ষণাৎ স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। দিদিকে শিক্ষা দিতে তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ এনে তাকে জেলে পোরা হয়। পুলিশ হেফাজতে ভাইয়ের উপর অকথ্য নির্যাতন দেখে রুচিকা শেষপর্যন্ত আত্মহত্যা করে। এখানেই হয়তো সমস্ত ঘটনায় ইতি পড়ত যদি না দুটি দশক ধরে রাঠোরের বিরুদ্ধে লড়ে যেত রুচিকার প্রিয় বান্ধবী অনুরাধা প্রকাশ। রুচিকার নিজের পরিবার একটি পর্যায়ে হার মেনে নিলেও হার মানেননি অনুরাধা। তাঁর দীর্ঘ লড়াইয়ের ফসল হিসেবে ২০০৯ সালে এসপিএস রাঠোর আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়। যদিও শাস্তি হিসেবে জোটে মাত্র ছ’মাসের জেল এবং এক হাজার টাকার জরিমানা।
রুচিকা গিরহোত্রার প্রাতিষ্ঠানিক হত্যার পর কেটে গিয়েছে তিন তিনটে দশক। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর দিকে চোখ রাখলে বোঝা যায়, সেই ট্রাডিশনই সমানে চলছে। কুস্তিগিরদের চলমান আন্দোলনই তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। রেসলিং ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ার সভাপতি ব্রিজভূষণ সিংয়ের বিরুদ্ধে এক নাবালিকা সহ সাতজন যৌন হেনস্থার অভিযোগ দাখিল করেছেন। সাক্ষী মালিক, ভিনেশ ফোগত সহ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কুস্তিগিরেরা মন্ত্রীদের দরজায় দরজায় ঘুরেও সাড়া না পেয়ে শেষ পর্যন্ত রাস্তায় বসতে বাধ্য হয়েছেন। পরিণামে তাঁদের কপালে জুটেছে আইন রক্ষকের লাঠির বাড়ি। টানা আন্দোলনের জেরে পুলিশ অবশেষে তদন্ত করতে শুরু করলেও বিচারের পরিণতি নিয়ে আশঙ্কা কাটছে না। আরও বেশি আশঙ্কা হচ্ছে এই ভেবে যে বিশ্বখ্যাত কুস্তিগিরদেরই যদি বিচার চাইতে গিয়ে চোখের জল ফেলতে হয় তাহলে খেলার মাঠে সদ্য পা রাখা ছেলে বা মেয়েটা এমনই পরিস্থিতির মুখে পড়লে লড়াইয়ের জোরটুকু কোথা থেকে পাবে?
চক দে ইন্ডিয়া থেকে দঙ্গল— সব গল্পেই ঘুরেফিরে উঠে এসেছে পিতৃতান্ত্রিক সমাজকে উপেক্ষা করে মেয়েদের খেলার মাঠে যুদ্ধ জেতার গল্প। কিন্তু মাঠের বাইরে যৌন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা কীভাবে জিততে হয় তার নিদান কোনো সিনেমাই দিতে পারেনি। বাবার বয়সী কোচের নোংরা স্পর্শে যে কিশোরী অ্যাথলিট প্রতিদিন বাথরুমে চোখের জলে ভাসে, গ্রাম থেকে আসা যে ফুটবলারকে খেলতে দেওয়ার বিনিময় মূল্য হিসেবে শোওয়ার প্রস্তাব পেতে হয় সেই মেয়ে (কিছু ক্ষেত্রে ছেলেদেরও) প্রতিদিনের শক্তিক্ষয়ের হিসেব কোনো খেলার পাতায় জায়গা পায় না। তবুও এর মধ্যেই ব্যতিক্রম হয়ে ভরসা জোগান অনুরাধা প্রকাশরা। রাষ্ট্রের লাল চোখের উল্টো দিকে ভেবেও ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে রাত্রি জাগেন কুস্তিগিরেরা। এই ঘনঘোর অন্ধকারে আলোর ক্ষীণ রেখা হয়ে লড়ে যান তাঁরা।
Discussion about this post