সময়টা ছিল ১৯১৮ সালের শরৎকাল। প্রথম মহাযুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। ঠিক সেই সময় শুরু হল ভাইরাস ঘটিত কুখ্যাত এক মহামারী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা ব্রিটিশ, জার্মান, ফরাসী ও আমেরিকান সেনা শিবিরগুলিতেই এই রোগটির প্রথম উৎপত্তি। বিশ্বযুদ্ধে যত না মানুষ মারা গিয়েছিলেন, তার অনেক বেশি সংখ্যক মানুষ মারা যান এই ফ্লু’তে। শুধু মাত্র মার্কিন মুলুকেই প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ প্রাণ হারাযন এই ফ্লুর কবলে। পরে রোগটি সংক্রামিত হতে হতে বিভিন্ন দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে যায়। স্পেন দেশে প্রথম এই রোগটিকে সনাক্ত ও নথিভুক্ত করা হয়েছিল। সেই থেকেই এর নাম হয় ‘স্প্যানিশ ফ্লু’।
স্প্যানিশ ফ্লু সংক্রামিত হত মূলতঃ মানুষের শ্বাসতন্ত্র বা ফুসফুসের মাধ্যমে। এই ফ্লুটি ছিল রীতিমত কষ্টকর একটি রোগ। রোগটির ফলে রোগীর কাশির সঙ্গে নাক মুখ দিয়ে রক্ত পড়ত। এমনকি কান দিয়েও রক্ত ঝরতো মাঝে মধ্যেই। এর সঙ্গে ছিল গা-হাত-পায়ে অসহ্য যন্ত্রণা। ১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লু বিশ্বব্যাপী মহামারী হিসাবে দেখা দেয়। রোগটির ফলে সারা বিশ্বে প্রায় ৫০ কোটি মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে। মৃতের সংখ্যা প্রায় পাঁচ কোটি। তবে এই ফ্লুতে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সীরা।
ভারতেও বিস্তার করেছিল এই ফ্লু। আজকের করোনা ভাইরাসের মতই বিদেশ থেকে আসা লোকজনের মাধ্যমে এই রোগ প্রথম ছড়িয়ে পড়ে বম্বে (বর্তমানে মুম্বই) শহরে। সেখান থেকেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংক্রামিত হয় এটি। যেহেতু বম্বে থেকে শুরু হয়েছিল তাই লোকমুখে ভারতে বম্বে ফ্লু নামে পরিচিত হয় এই রোগ। বম্বেতেই এই রোগের প্রভাব ছিল সব থেকে বেশি। একদিনে প্রায় আটশো জনের মৃত্যু ঘটে এর কবলে। ভারতে স্প্যানিশ ফ্লুর আক্রমণ দু’দফায় হয়েছিল। প্রথম দফায় তুলনামূলক ভাবে শিশু ও বৃদ্ধদের ক্ষতি হয় বেশি। দ্বিতীয় দফায় এই ফ্লু প্রাণ কাড়ে ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সীদের। ফ্লু প্রতিরোধে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার প্রথমটায় তেমন কিছু উদ্যোগ নেয়নি। পরে রোগটি মহামারী আকার নিলে সরকার কিছু ব্যবস্থা নেয়। তার মধ্যে ভারতে বিদেশীদের প্রবেশ বন্ধ করতে ভিসাও বাতিল করে দেওয়া হয়। এছাড়া এখনকার মত তখনও বড় জমায়েত এড়িয়ে চলার বা ঘর বন্দী থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এইসব করেও রোগ নিয়ন্ত্রণ করা কিন্তু তেমন ভাবে সম্ভব হয়নি। এর ফলে ভারতে মোট ২ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। শোনা যায় মহাত্মা গান্ধীও এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তবে কিছুদিন পর তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন।
আজকের করোনা ভাইরাসও কিছুটা এই স্প্যানিশ ফ্লুয়ের মতোই আকার ধারণ করেছে। যত দিন যাচ্ছে আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। কাজ চলছে প্রতিষেধক তৈরির, তবুও ভরসা পাচ্ছেন না সাধারণ মানুষ। এই সময় দরকার জন সচেতনতা গড়ে তোলা। সরকারী সমস্ত নির্দেশ এবং বিশেষজ্ঞের পরামর্শ যাতে মানুষ মেনে চলেন, তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ারও প্রয়োজন। তবেই দ্রুত এই অবাঞ্ছিত শত্রুর মোকাবিলা করে নতুন রোগমুক্ত জীবন ফিরে পাবেন পৃথিবীর মানুষ।
Discussion about this post