চৈত্র সেল! চৈত্র সেল! ৬০ টাকা ৭০ টাকায় টিশার্ট নিতে চলে আসুন কালীঘাটের ফুটপাতে। কী ভাবছেন বিজ্ঞাপন দিচ্ছি? না তা একেবারেই নয়। এটা কোনো বিজ্ঞাপনের চটকদারি ঘোষণা নয়। তবে এইভাবেই ফুটপাতের বিপনণে চলে তাঁর রোজনামচাটা। এক সাদামাটা জীবনবৈচিত্র্যে যাপন করেন হাজরার বাম্পাই চক্রবর্তী। কিন্তু বিপণনের আড়ালে তাঁর আসল পরিচয়ের হদিশ পেলে আপনি থমকে দাঁড়াবেন। অভাবের ওই এক কামরা ঘর থেকেই তাঁর প্রতিভা ছড়িয়ে পড়েছে সারা বাংলায়।
লেখালেখির শখ তাঁর বহুদিনের। প্রোফাইল ঘাঁটলেও হু হু করে বেরিয়ে পড়ে কত শত কবিতার চিরকূট। সুর লয় ছন্দের সঙ্গে যেন তাঁর এক আত্মিক যোগ রয়েছে। তাই কোনোরকম পেশাদারী প্রশিক্ষণ নাছাড়াই গানের সুর বাঁধেন বাম্পাই। আর তাঁর সেই বাঁধা গান বহুদিন ধরেই রেকর্ড হয়ে আসছে স্টুডিওতে। লোকসঙ্গীত কিংবা আধুনিক গান, তালিকাটা বেশ বড় মাপেরই। তাঁর লেখা ও সুরে গলা দিয়েছেন রূপঙ্কর বাগচী, ঊষা উত্থুপ। সিধু, ইমন চক্রবর্তী, জয় সরকারের মতো তাবড় তাবড় সঙ্গীত শিল্পীরা। ‘বুড়ো সাধু’ সিনেমায় প্লেব্যাকেও গান গেয়েছেন তিমির বিশ্বাসের সাথে। ‘নেরোল্যাক’ এবং ‘বঙ্গশ্রী’ থেকে বিশেষ সম্মাননাও তাঁর ঝুলিতে এসেছে। যদিও এই উঁচুদরের এক গুণী মানুষকেই আজ বসতে হয়েছে ফুটপাতের চৌহদ্দিতে। গোটা একটা বছরের লকডাউনে সংসার চালানো একপ্রকার অসম্ভব হয়ে উঠেছিল তাঁর কাছে। তাই সাত পাঁচ না ভেবে জামাকাপড় বিক্রির পথই বেছে নিয়েছিলেন তিনি। সরস্বতী পুজোর ঠিক আগের সময়টায়, দিনরাত এক করে তিনি ও তাঁর স্ত্রী নিজে হাতে টেনেছেন তুলি। বাড়িতে বসেই বিক্রি করেছেন ফেব্রিকের আকর্ষণীয় ডিজাইনের পাঞ্জাবী। কিন্তু তাতেও আর্থিক অবস্থার বিশেষ উন্নতি হয়নি। তাই কালীঘাটের ফুটপাথেই ঝাঁপ ফেলা যে কোনো দোকানের সামনেই সাজিয়ে বসেছেন পসরা।
বুম্পাই কোনো কাজকেই ছোট মনে করেন না তিনি। মাছের বাজারে মাছ বিক্রি থেকে শুরু করে ৩০ টাকার রোজের কাজ, সবধরনের অভিজ্ঞতাই রয়েছে এই শিল্পীর। কাছের মানুষরা চিরকাল দূরত্বেই থেকে গেছে। তাই সেভাবে সাহায্য না এলেও কাজে উৎসাহ দিয়েছেন অনেকেই। বেশ কিছু বন্ধুরা পাশে থেকেছেন, অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন বলেই জানান তিনি। ইতিমধ্যেই ‘চন্দ্রবিন্দু’ ব্যান্ডের পরিচিত মুখ উপল আর্থিক সাহায্য করে পাশে থেকেছেন। তাঁর স্ত্রীয়ের অবদানও যে জীবনে অনেকখানি তাও নিঃসংকোচে স্বীকার করেন বুম্পাই। তিনি বরাবর মাটির কাছাকাছি থেকেই কাজ করতে চেয়েছেন। ফুটপাতে বসা ওই রোজগেরে মানুষগুলোর সঙ্গটাই উপভোগ করেন তিনি। তাদের বাস্তব জীবনের সঙ্গে একাত্ব হয়ে অনায়েসে তা তুলে নিতে পারেন কলম। অভাব কোনোদিনই নষ্ট করতে পারেনি তাঁর শিল্পী সত্ত্বাটাকে। নতুন প্রজন্মের কাছে এই ব্যক্তিত্ব সত্যিই এক মাইলস্টোনের মতো। যারা এখনো পরিচয় পরিচিতির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছেন; তাদের উদ্দেশ্যে তিনি শুধু বলেন,”কিছু করার জন্যে করো, কিছু হওয়ার জন্য করো না”।
Discussion about this post