ইরিত্রিয়া ৩২তম স্বাধীনতা দিবস পার করল। উত্তর-পূর্ব আফ্রিকায় লোহিত সাগরপারের দেশ ইরিত্রিয়া। প্রথমে ইতালির উপনিবেশ, পরে পার্শ্ববর্তী ইথিওপিয়ার শাসনের বিরুদ্ধে ইরিত্রিয়ার জনগণ স্বাধীনতার লড়াই শুরু করেন। ১৯৯১ সালে ত্রিশ বছর পর ইথিওপিয়ার হাত থেকে ইরিত্রিয়া স্বাধীন হল। তবে, সেই স্বাধীনতার ঠিক কতখানি ছিল ইরিত্রিয়ার মহিলাদের জন্য? ১৯৭০ সাল থেকে এই স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিল Eritrean People’s Liberation Front (EPLF) এবং মার্ক্সিস্ট-লেলিনিস্ট আদর্শ। EPLF-এর ৩০% জুড়ে ছিলেন ইরিত্রিয়ান নারীরা। সামরিক বাহিনীর প্রায় এক তৃতীয়াংশই ছিলেন মহিলা। পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছিলেন তাঁরা।
কিন্তু মজার বিষয় হলো, স্বাধীনতার পর যখন এই মহিলা যোদ্ধারা ঘরে ফিরলেন, তখন তাঁদের দেখা হল ‘non-marriage meterial’, অর্থাৎ অবিবাহযোগ্যা নারী হিসেবে। কারণ যুদ্ধের পর তাঁদের শরীরে নারীসুলভ কোমলতা ছিল না। প্রচুর মহিলা স্বাধীনতার পর তাঁদের বাকি জীবন কাটিয়েছেন ঘরে বন্দি অবস্থায়, একা। তাঁদের স্বাভাবিক নাগরিক জীবনে মিশতে দেওয়া হয়নি। বছরের পর বছর যুদ্ধের ময়দানে কাটানোর ফলে দৈনন্দিন জীবিকা নির্বাহের কৌশল তাঁদের আয়ত্তে ছিল না। তাঁদের আচার-ব্যবহার, শারীরিক গঠনের মধ্যে ছিলনা মেয়েলি গুণাবলি। অথচ, এই সাংস্কৃতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক বিপ্লবের কেন্দ্রবিন্দু ছিল মূলত নারীমুক্তি এবং মার্ক্সবাদ। ইরিত্রিয়ান পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট দেশের সংকীর্ণ সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জেগে উঠেছিল। ফোর্সড্ ম্যারেজ, বাল্যবিবাহ, পণপ্রথার বিরুদ্ধে প্রশ্ন উঠেছিল। ইরিত্রিয়ান উইমেন্স অ্যাসোসিয়েশন বলেছিল, “marriages based solely on comradely love.”
কিন্তু এই মহিলা যোদ্ধাদের জীবন হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ। মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়ে পরেছিলেন তাঁরা। সাধারণ নারীসুলভ বৈশিষ্টের অনুপস্থিতির জন্য সমাজ তাঁদের অচ্ছুৎ করে রেখেছিল। বেশিরভাগ মহিলার বিয়ে ভেঙে গেছিল চেহারার জন্য। এর সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছিল এই নারীদের ‘সতীত্বের শুচিতা’ নিয়েও। এই সময় বহু মহিলা আত্মহত্যার পথও বেছে নিয়েছিলেন। ইরিত্রিয়ান হিউম্যান রাইটস অ্যাক্টিভিস্ট হেলেন কিডান বলছেন, “The collapse of their marriages and their stigmatisation had a detrimental effect on them, leading to depression and even suicide.”
দীর্ঘ ১৫-২০ বছর ধরে সংগ্রাম করে স্বাধীনতা অর্জনের পর পুরুষরা যথারীতি নিজেদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পেরেছিলেন। যুদ্ধ পরবর্তী মানসিক ও শারীরিক সমস্যাগুলি কাটিয়ে উঠতে সমাজ স্বাভাবিকভাবেই পাশে দাঁড়িয়েছিল তাঁদের। যেমন আর পাঁচটা দেশে হয়ে থাকে। যেখানে যোদ্ধা হিসেবে পুরুষ আলাদা সম্মান লাভ করে থাকেন। কিন্তু মহিলা যোদ্ধাদের ক্ষেত্রে তা হয়নি। বরং জুটেছে ঘৃণা, সন্দেহ। আসল জীবনযুদ্ধ যেন শুরু হয়েছে যুদ্ধের পরেই, স্বাধীনতা লাভের পরেই।
Discussion about this post