যাদের গান না শুনলে এ জীবন ‘তুচ্ছ’! যাদের স্বপ্ন উড়েছে এক ঝাঁক ‘হলুদ পাখি’ হয়ে! যারা পাশে দাড়িয়েছে ‘দণ্ডিত যত পক্ষীরাজের’! যারা দেখেছে ‘বুদ্ধ হেসেছে’, যারা লড়েছে ‘রাজায় রাজায়’! যারা ভালোবেসে বলেছে আমি ‘শুধু চেয়েছি তোমায়’! যারা যত্ন নিয়ে বলেছে ‘সাবধানে রাস্তা পেরিও’! প্রচন্ড গর্জনে তারাই করেছে ‘লাশ কাটা ঘরে ময়না তদন্ত’! মরুভূমির প্রচন্ড রুক্ষতাকেও হার মানাতে পারে যারা, ক্যাকটাস নামে পরিচিত তারা! আজ্ঞে হ্যাঁ, আমাদের সঙ্গে আড্ডায় ছিলেন সকলের প্রিয় সিধু দা! এবার সেই মুহূর্ত যাপনের সাক্ষী হতে চলেছেন আপনারাও!
বাংলা ব্যান্ড নিয়ে পলিটিক্সের কানাঘুষো তো আকছারই শোনা যায়! বাস্তবে তার রূপ কতটা শোচনীয়?
বাংলাদেশে ‘বাম্বা’ বলে একটি অর্গানাইজেশন রয়েছে সেখানে বিভিন্ন ব্যান্ডের মেম্বাররা একত্রিত ভাবে কাজ করে। বাম্বার মজাটা হচ্ছে সেখানে একটি ব্যান্ড একটি গান বা অ্যালবাম রিলিজ করবে এবং বাকিরা সেটাকে সাপোর্ট করবে। স্বাভাবিক ভাবেই তারপর সেটা প্রমোট হয়! দুর্ভাগ্যবশতঃ এপার বাংলায় এমন কোনো অর্গানাইজেশন নেই এবং আন অর্গানাইজড ভাবেও সাপোর্ট খুব দুর্বল। ওই যে কথায় আছে না, বাঙালি এক বাটি কাঁকড়ার মতো, একজন বেরিয়ে যেতে চাইলে বাকিরা পা টেনে ধরে। এই ধরনের মানসিকতা সব জায়গাতেই আছে, সব জীবিকাতেও আছে, বাংলা ব্যান্ডেও তার অভাব নেই!
রিয়্যালিটি শো’র যুগে বাংলা ব্যান্ডের ভবিষ্যৎ কতটা উজ্জ্বল?
রিয়ালিটি শো’র সাথে বাংলা ব্যান্ডের প্রাথমিকভাবে কোনও বিরোধ নেই! রিয়ালিটি শো শুধুই চর্বিত চর্বণ, পুরনো কিছু গ্রেটেস্ট হিট, সেগুলোকেই আবার করে গাওয়ানো হয়। আর বাংলা ব্যান্ড সেখানে অবশ্যই নতুন গান বানায়! রইল বাকি পাড়ায় পাড়ায় বিভিন্ন ক্লাব, অর্গানাইজেশন কমিটি, পুজো কমিটি যারা বিভিন্ন শিল্পীদের আহ্বান জানান। স্বাভাবিক ভাবেই রিয়ালিটি শো’র চাকচিক্যে ভরা মঞ্চে নবীন শিল্পীদের দেখে তাদের ডাকার একটা প্রবণতা দেখা যায় আজকাল। অবশ্যই তারা ভালো শিল্পী, খুবই ভালো গায়! এই শো পাওয়ার লড়াইতে বাংলা ব্যান্ড ও রিয়ালিটি শো’র মধ্যে কোথাও গিয়ে একটা প্রতিযোগিতা রয়েছে। একটা সময় বাংলা ব্যান্ড আধিপত্য করেছে। ইদানিং রিয়ালিটি শো’র আধিপত্য লক্ষ্য করা যায়।
একজন সঙ্গীত শিল্পী অত্যন্ত ভাবনা চিন্তা ও পরিশ্রমের সঙ্গেই তার প্রতিটা গান বাঁধেন! তারপরও কিছু কালজয়ী গান ছাড়া বাকি গানগুলি সেভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারছে না কেন?
সেটা শ্রোতার সমস্যা আমাদের নয়! আমাদের কথা তো ছেড়েই দিলাম! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ক্ষেত্রেও মানুষ ওই টপ ফাইভ বা টপ টেন গান বলতে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ওই একই গান বলবে। ‘পুরানো সেই দিনের কথা’, ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’, ‘আয় তবে সহচরী’, ‘আমারও পরাণ যাহা চায়’! সুতরাং কোনো শিল্পী বা কম্পোজারদের কতগুলো গান দিয়ে চিহ্নিত করে দেওয়ার একটা প্রবণতা শ্রোতা বা দর্শকদের মধ্যে চিরকালই ছিল, আজও রয়েছে! যেমন ক্যাকটাস মানেই ‘হলুদ পাখি’! তবে এমনও কিছু শ্রোতার সঙ্গে দেখা হয়েছে তাদের কারও কারও কাছে হয় তো ‘তুচ্ছ’ গানটা তাদের শোনা বেস্ট গান, তো কেউ বলছেন ‘সাবধানে রাস্তা পেরিও’ গানটি তার জীবনের এক নম্বর গান! সুতরাং, যারা শোনার তারা গুছিয়েই শুনবে আর যারা ওপর ওপর শুনবে তারা ওই টপ ফাইভ, টপ টেন এভাবেই শুনবে!
সিধু-পটা নামটা শুরু থেকেই হ্যাশট্যাগের মতো ট্রেন্ডি ও জনপ্রিয়! সাফল্যের চাঁদ যখন একেবারে মধ্য গগনে ঠিক তখনই বাজলো বিচ্ছেদের সুর! দুটো নাম আলাদা আলাদা ভাবে হাঁটতে শুরু করলো দুই বিপরীত মেরুতে! তারপর কবি গুরুর ছোট গল্পের মতো ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’। এই নতুন করে জুড়ে যাওয়া কে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন, মিরাকেল নাকি বন্ধুত্বের টান?
না, এই বিষয়ে টিকে মিরাকেল বলবো না! মিরাকেল যদি বলতেই হয় তবে প্রথম বার পটার সাথে আলাপ হওয়া ও এক সাথে পথ চলাকেই বলব। পরবর্তীকালে মতভেদ হতেই পারে, তবে সেটা যে শুধু আমার সাথেই হয়েছে এমনটাও নয়! প্রথমবার পটার বেরিয়ে যাওয়াটা ব্যান্ড মেম্বারদের সাথে মিউজিক্যাল কিছু ভাবনার পার্থক্য ছিল! তারপর পটার ফিরে আসা। দ্বিতীয়বার পটার বেরিয়ে যাওয়ার সময় আমার সাথে কোনো ভাবেই কোনো মত বিরোধ ছিল না, মিউজিক্যাল জায়গা থেকে বা ব্যক্তিগত দিক থেকে! ব্যান্ডের অন্যান্য মেম্বারদের সঙ্গে বিরোধটা খুব তীব্র জায়গাতে পৌঁছে গিয়েছিল। সেই জন্য পটার দ্বিতীয়বার প্রস্থান! সেই জায়গা থেকে আবারও আমার ও পটার হাত ধরা-ধরি! তবে সেটা সমস্ত পুরনো মেম্বারদের ত্যাগ করে তবেই। কারণ সেটা পটার একটা ইচ্ছে ছিল বা অভিলাষা বলা যেতে পারে যে, ‘যদি সিধু দা’র সাথে ফিরতে হয়, তাহলে অমুক অমুক কে নিয়ে চলবো না! সিধু দা যদি এই সবের বাইরে এসে কিছু করতে পারে, তো নিশ্চয়ই করব। তাই জানুয়ারি দু’হাজার একুশে এসে আবারও পটা ও সিধু মিলে ক্যাকটাস পুনর্গঠন করেছে এবং সম্পূর্ণ নতুন লাইন আপ! কাজেই এটাকে বুন্ধুত্বের টান, গানের টান, একে অপরের সঙ্গে বোঝাপড়া এবং মিউজিক্যাল নির্ভরতা বলব! এক্ষেত্রে এক অদ্ভুত মিউচুয়াল ডিপেন্ডেন্সি পটার ও আমার মধ্যে রয়েছে।
একদিকে যেমন ফ্যাসিবাদী মানসিকতার বিরুদ্ধে শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই, অন্য দিকে বেচেঁ থাকার লড়াই। এই জীবন যুদ্ধে কাছের মানুষদের কতটা পাশে পেয়েছেন?
জীবন যুদ্ধ কথাটা খুব খুব নাটকীয় আমার কাছে, আমার কাছে জীবনটা কোনো যুদ্ধ নয়! কুরুক্ষেত্র যেমন মহাভারতের একটা অংশ বিশেষ, তেমন জীবন যুদ্ধে রূপান্তরিত হয় কিছু ক্ষেত্রেই মাত্র, তবে পুরোটা নয়। জীবন একটা পথ চলা! এই পথ চলতে অনেক কাছের মানুষ দূরে চলে গেছে আবার অনেক দূরের মানুষ কাছে চলে এসেছে! দুটোই ঘটেছে এবং প্রায় সমান অনুপাতেই ঘটেছে! এটা নিয়ে আলাদা করে তেমন মন খারাপ বা এক্সাইটমেন্ট নেই! কচি বয়সে যেমন খুব সহজেই বন্ধুত্ব হয়ে যায়, একটা বয়সে এসে কিন্তু কিছু উদ্দেশ্য, স্বার্থ জড়িয়ে থাকে। স্বার্থের সংঘাত ঘটলে যেমন কাছের মানুষও দূরে সরে যায় ঠিক তেমনই স্বার্থের মেলবন্ধন ঘটলে অনেক দূরের মানুষও আপন হয়ে যায়! স্বার্থ বলতে আমি কিন্তু কোনো নেগেটিভ অর্থ বোঝাচ্ছি না, স্বার্থ বলতে আমি পয়েন্ট অফ ইন্টারেস্ট বোঝাতে চাইছি!
সিধু-পটা নাকি ক্যাকটাস! কারা বেশি পারফেকশনিস্ট?
ক্যাকটাস! কারণ ক্যাকটাস মানে আমাদের টিম যা করেছিল বা যেসব গান আমরা তৈরি করেছিলাম, বিশেষ করে তুচ্ছ এবং ব্লা ব্লা ব্লা! এই দুটি গানের জন্য আমাদের একটা দারুণ রকম টিম ওয়ার্ক ছিল। ততদিনে আমাদের জনপ্রিয়তা একটা জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিল। ইতিমধ্যেই তখন তিনটে অ্যালবাম রিলিজ করে গিয়েছে, আমাদের হাতে তখন আট-দশটা হিটস গান! আমি সেই জায়গা থেকে বলছি, কম্পোজিশন তো নিজের জায়গায় থাকবে কিন্তু টেকনিক্যালি সেটাকে কতটা ইন্টারন্যাশনাল লেভেলে নিয়ে যাওয়া যায় সেই বিষয়টা নিয়ে কিন্তু ক্যাকটাস ভীষণ পিট পিটে ছিল। সেই অনুযায়ী কাজ করেছিল, এমন কি আমরা মিক্সিং মাস্টারিং আমাদের দেশেই করাইনি! ওটা বিদেশে হয়েছে। সেটা বিদেশে কাকে দিয়ে করলে ওই ধরনের স্ট্যান্ডার্ড রিচ করবে সেটা নিয়ে রিসার্চ করা, সেটা খুঁজে বার করা ও যোগাযোগ স্থাপন করা। মানে আমি ২০০৮ সালের কথা বলছি যখন ইন্টারনেট এতটাও সহজলভ্য ছিল না! সেই অবস্থায় বিদেশি একজন সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার খোঁজা এবং তাকে দিয়ে মিক্সিং মাস্টারিং করানো এটাকে অবশ্যই আমি বেশি পারফেক্টশানিস্ট হওয়ার একটা দারুন প্রচেষ্টা বলব! আমি সত্যি গর্বিত সেটার জন্য। তাতে কিন্তু আমার ভূমিকা সামান্যই ছিল, বাদ বাকি মেম্বাররা বিরাট ভূমিকা পালন করেছেন।
বাংলা ব্যান্ডের উঠতি কারিগরদের জন্য কি বার্তা দিতে চান?
উ: এই মুহূর্তে যে খুব পালে হাওয়া রয়েছে বাংলা ব্যান্ডের তা নয়! এই সময়টাও একটা সময়, আবার এই সময়টাই শেষ কথা নয়! আমার মনে হয় বাংলা গান, বাংলা ইন্ডিপেন্ডেন্ট গান, বাংলা ব্যান্ডের গানের পালে হাওয়া চলেছে বা লাগলো বলে আর কি! কারণ ফিল্ম সং এ মানুষ মজে ছিল, আবার বোরও হয়েগেছে। ওই একই পুরনো জিনিস পত্র সব ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আসছে। সুতরাং বাংলা ব্যান্ডের পালে হাওয়া লাগবে, সেই দিনের অপেক্ষা করো, নিজের কাজটা যত্ন করে করো, রিয়ালিটি শো’তে বাজিয়ে নিজেকে হিরো ভেবো না, কোনো নির্দিষ্ট ব্যান্ডের বা তাদের ফ্যান দলের ছত্রছায়ায় এসো না! তাতে করে একটা সময় এসে তারা তোমাদের খর্ব করেই রাখবে কারণ সেটাই তাদের উদ্দেশ্য!
Discussion about this post