বাংলার এতো কালী পুজোর মধ্যে ঐতিহ্য বহন করে চলেছে প্রাচীন কিছু পুজো। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য রানাঘাটের সিদ্ধেশ্বরী মায়ের পুজো। ইতিহাস বলছে, এ পুজো প্রায় তিনশো বছরের পুরনো। এটি শুরু হয়েছিলো দস্যুর তেজ এবং রাজার আদেশের যুগলবন্দিতে। ডাকাত কথাটা শুনতে ভয়ঙ্কর হলেও, শোনা যায় রাণা ডাকাত ছিলো গরিবদের দেবতা। তাঁরই ঘাঁটি ছিলো বলে এই স্থানের নাম রানাঘাট হয় বলে জানা যায়। রাণা ডাকাতের দল ডাকাতিতে বেরোনোর আগে পুজো করতো দেবী সিদ্ধেশ্বরীর। দোসর ছিল নরবলি। আর বলির পর দেহ ফেলে দেওয়া হতো কুয়োয়। তবে দস্যুর হাতে দেবীর প্রতিষ্ঠা হয়নি। দেবীর প্রতিষ্ঠা হয় কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের হাত ধরে। কথিত আছে, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র স্বপ্নে দেখেন রানা ডাকাতের পুজিতা মা অনাবৃতা অবস্থায় পড়ে আছেন। তিনি স্বপ্নাদেশ পান দেবীকে প্রতিষ্ঠা করার। এর পরেই রাজার আদেশে হয় মন্দির প্রতিষ্ঠা। গতি আসে মাতৃ আরাধনায়।
অন্যদিকে, এও শোনা যায় সাধক রামপ্রসাদ রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে কথা দিয়েছিলেন, তিনি মায়ের দর্শন করতে আসবেন। কিন্তু আসার পথেই বিপদ। বাঁধ সাধে রানা ডাকাত। মাতৃশক্তির আরাধনায় ভক্ত রামপ্রসাদকে বলি দেওয়া হবে বলে ঠিক হয়। তবে বলির সময়ে তাঁর গান ছুঁয়ে ফেলে ডাকাত হৃদয়কে। তাই সেবার মুক্তি পান রামপ্রসাদ। ভক্তের ওপর মায়ের কৃপা থাকবে না, তা কি হয়? যদিও সেকালের মন্দির আজ আর নেই। অতীতে এক ব্রিটিশ প্রাণভয়ে এই মন্দির আশ্রয় নিয়েছিলো বলে জানা যায়। যার ফল স্বরূপ এলাকাবাসী সে মন্দির ভেঙে মায়ের মূর্তি জলে ভাসিয়ে দেয়।
পরে আবার নতুন করে সূচনা হয় পুজোর। যশোর থেকে আনা হয় পুরোহিতদের। যার মধ্যে ভোলানাথ ভট্টাচার্য ছিলেন প্রথম পুরোহিত। সিদ্ধিদাত্রী এই দেবীর নতুন মূর্তি স্থাপন হয় তাঁরই হাতে। সুদূর বারানসী থেকে আনা হয় মায়ের কষ্টিপাথরের তৈরি এই নতুন মূর্তি। উচ্চতায় যা মাত্র তিন হাত। সেই থেকে আজ অবধি মায়ের এই মূর্তির পুজোই হয়ে আসছে। বর্তমান সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের এলাকার সাথে তখনকার সিদ্ধেশ্বরী তলার অনেক তফাত। সেকালে এই এলাকা ভরানেতলা নামে পরিচিত ছিলো। চূর্ণী নদীর পার্শ্ববর্তী সেই এলাকার চারিদিকে জঙ্গল ও বটগাছ মিলে ছিলো এক গা ছমছমে পরিবেশ। এখনও মন্দিরের সামনে আছে বলির থান, আর তার পরেই নাট মন্দির। মা সিদ্ধেশ্বরীর পাশাপাশি বছরে চারদিন পুজো হয় মা অন্নপূর্ণার। বর্তমান মন্দিরে মহাদেব এবং রাধা মাধবের বিগ্রহ আছে।
তবে তিনশো বছর ব্যাপী এই পুজো এখন অনেকটাই পরিচিত। কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে সারারাত চলতে থাকে মানুষের সমাগম। পুজোর দিনগুলোয় রাত জুড়ে চলে পুলিশ পাহারা। গোটা রাত জুড়ে হয় দেবীর পুজো। আলোয় আলোয় সেজে ওঠে পুরো মন্দির প্রাঙ্গণ। উৎসবের দিন এবং নিত্য পুজো চলাকালীন প্রতি বছর মায়ের মূর্তি সংস্কার করা হয়।
Discussion about this post