কাবুলিওয়ালার কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা ধার নেওয়ার সময় শর্ত ছিলো সময় মতো সুদের টাকা পরিশোধ করতে না পারলে মেসে হামলা হবে। জাঁদরেল সেই কাবুলিওয়ালার হাত থেকে বাঁচতেই মূলত লেখালেখির শুরু শিবরাম ওরফে শিব্রাম চক্কোত্তির। তিনি নিজে বলেছেন “গায়ের জোর নেই বলে রিকশা টানতে পারি না তার বদলে কলম টানি। কলমের ওপর টান আমার এইটুকুই।” কলমের পাশাপাশি, সংসার জীবনের প্রতি টানও তাঁর খুব যে ছিল, তা বলা যায়না। শিবরামের জন্ম কলকাতায় হলেও তাঁর কৈশোরের অধিকাংশ সময়ই কেটেছে পাহাড়পুর আর চাঁচলে। বাবা শিবপ্রসাদ চক্রবর্তী ছিলেন কিছুটা সন্ন্যাসী প্রকৃতির। মা শিবরাণী দেবির মধ্যেও ছিলো আধ্যাত্মিকতার প্রচ্ছন্ন ছায়া। ফলে ছোটবেলা থেকেই বন্ধনহীন মুক্ত পরিবেশে বড় হয়েছিলেন শিবরাম। সুযোগ পেলেই উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়ানোর অদম্য ইচ্ছে তখন থেকেই। এই ভবঘুরে বিচিত্র জীবনকে নিজের মত চালানোর পথে বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে তাঁর অদ্ভুত বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়।
“নেশা করলে রাবড়ির নেশা করাই ভালো”, মনে করতেন শিবরাম চক্রবর্তী!
তেমনি একটি ঘটনা হল শিবরামের কাগজ বিক্রির গল্প। গ্রামের বাড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতা এসেছেন সবে। কী করে পেট চলবে জানা নেই। শুরু হল খবরের কাগজ বিক্রি। হেদুয়া, শ্যামবাজার, বউবাজার, গোলবাজার সর্বত্র। কিন্তু রোজের রোজগার রোজই খেয়ে আর সিনেমা দেখে শেষ হয়ে যায়। রবিবার ছুটির দিন বলে কাগজ বিক্রি কম। শিবরাম কিন্তু কাগজ তুলে বিক্রির চেষ্টাই করতেন না। ঠিক সন্ধেবেলায় উত্তর কলকাতার একটি সিনেমা হলের সামনে গিয়ে তিনি হাজির হতেন। রবিবার হাউসফুল। সিনেমা শুরুর আগেও কাগজের কোনো চাহিদা থাকতনা। কিন্তু শো শুরুর একটু পর থেকেই হইহই করে বেরিয়ে এসে কাগজ কিনে নিয়ে ভিতরে ঢুকতেন দর্শকরা। কারণ? হলের সিটে ছারপোকার অত্যাচারে কাগজ না পেতে বসার উপায় ছিল না। শিবরাম তা ভাল মত জানতেন। কাগজ সব বিক্রি হলে নিজেও একটি কাগজ নিয়ে সোজা সিনেমা হলে। তাঁর টিকিট কাটা থাকত আগেই!
মন্দির কিংবা মসজিদ নয়, সর্ব ধর্ম সমন্বয়ে তিনি চেয়েছিলেন ‘পায়খানা’!
শিবরাম চক্রবর্তী নিজেকে কোনোদিন সাহিত্যিক ভাবেন নি। তিনি বলতেন, “…আমার লেখায় থাকে শুধু কিছু পোলা আর পান, পোলাপানদের জন্য লেখা ওই আমার।” তাঁর নিজের অবহেলাতেই বহু লেখা হারিয়ে গেছে। তিনি নিজেও থাকতে চেয়েছেন লোকচক্ষুর আড়ালে। সারাজীবন থেকেছেন মেসবাড়িতে। পেটে খাবার জোটেনি। তাঁর মৃত্যুও হয়েছে অসুস্থ অবস্থায়, প্রায় একাই। রাজনীতি করেছেন, জেল খেটেছেন, ফুটপাতে রাত্রিবাস করেছেন, সাংবাদিকতা করেছেন, সাহেব মারতে পিস্তলও ধরেছেন। তাঁর এই বিচিত্র জীবনের দিকে ফিরে তাকালে অবাক হতেই হয় বৈকি!
Discussion about this post