আদিম কাল থেকেই সময়ের সাথে সাথে সভ্যতার পরিবর্তন দেখা যায়। কিন্তু কালে কালে যেন আধুনিক নগর সভ্যতা অন্যান্য সভ্যতাগুলির নিজস্বতাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। তা সত্ত্বেও, এই গ্রহে অনেক সভ্যতা আছে যা আধুনিক নগর সভ্যতা থেকে নিজেদেরকে আগলে রেখেছে। সেরকমই ভারতের বুকে রয়েছে রহস্যে ঘেরা এমন একটি দ্বীপ যা এখনো আধুনিক মানব সভ্যতা থেকে অন্ততঃ কয়েক আলোকবর্ষ দূরে নিজেদের সরিয়ে রেখেছে। আন্দামানে অবস্থিত এক প্রত্যন্ত দ্বীপ নর্থ সেন্টিনেল আইল্যন্ড, যেখানে লুকিয়ে কিছু ভয়ঙ্কর রহস্য।
হাজার হাজার বছর ধরে এই দ্বীপের বাসিন্দা ‘সেন্টিনেলিজ’রা নিজেদেরকে বাইরের জগৎ থেকে আলাদা করে রেখেছে। কেউ তাদের ভাষা, সভ্যতা, জন জীবনের নাগালটুকুও পায় নি। সাহায্যের হাত বাড়ালেও জুটেছে এক রাশ বিরূপতা। এই বিলুপ্তপ্রায় মানব জাতির ধারে কাছেও কেউ কখনো ঘেঁষতে পারেনি। বিশেষজ্ঞদের মতে হাজার হাজার বছর ধরে এই দ্বীপের বাসিন্দা সেন্টিনেলিজদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নেই বললেই চলে। তাই বাইরে থেকে কোনো জীবাণু ছড়িয়ে পড়লে এই বিলুপ্তপ্রায় মানব জাতি যে একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এই সব কারণে সরকারি ভাবে এই দ্বীপকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয়েছে। দ্বীপের পাঁচ মাইল পর্যন্ত এলাকাকে সাধারণ মানুষ বা পর্যটক এর জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
জন অ্যালেন চাউের মৃত্যু যে বড়ই র্মমান্তিক তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। জন ছিলেন একজন আমেরিকান খ্রিস্টান মিশেনারি যিনি সেন্টনেলিজদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। ২০১৮ সালে তিনি বেআইনি ভাবে প্রবেশ করেছিলেন এই দ্বীপে। তাঁর মৃতদেহের সন্ধান এখনো মেলেনি। জনের চিহ্ন স্বরূপ মিলেছিল একটি ডায়েরি যেখানে জন লিখেছিলেন, “ঈশ্বর আমাদের যাবতীয় নজরদারি থেকে লুকিয়ে রেখেছেন।“ ডায়েরির শেষ পাতায় তিনি লিখেছেন “ঈশ্বর!এটাই শয়তানের শেষ ডেরা নয়তো? যেখানে কেউ কোনোদিন তোমার নামই শোনেনি।“ শুধু জনই নন, এর আগেও অনেকে সাহায্যের হাত বাড়াতে চেয়েছিলেন, জবাবে মিলেছিল আক্রমণ। ২০০৪ সালে সুনামির পর এক হেলিকপ্টার দ্বারা সরকারি ত্রাণ পাঠানো চেষ্টা করা হয়েছিল। যদিও গ্রহণের বদলে মিলেছিল তির আক্রমণ। ২০০৬ সালে দুইজন মৎস্যজীবি ভুলবশতঃ এই দ্বীপে পৌঁছলে অধিবাসীদের বিষ মাখানো তীরে মৃত্যু হয়।
তবে ষাটের দশক থেকে ‘অ্যানথ্রোপলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’র তরফ থেকে উদ্যোগ নিয়ে এই দ্বীপে সফর করা হয়। নৃতাত্ত্বিক টি এন পন্ডিত ছিলেন সেই সফরের প্রধান ব্যক্তি। তিনি দ্বীপে পা রাখেন বেশ কিছুক্ষণের জন্য। বাসিন্দারা সামনেও আসেনি আবার আক্রমণও করেনি। পরবর্তীকালে উপহার হিসাবে লোহার রড, বাসনপত্র, নারকেল পাঠানো হয় এবং তারা সেটা গ্রহণও করে। নব্বই দশকের গোড়ায় আরও এক ধাপ এগিয়ে সেন্টনেলিজরা তাদের হাত থেকে তাদের প্রিয় নারকেলও গ্রহণ করে। কিন্তু শেষ এখানেই যোগাযোগ এগোয়নি এর পরে আর। দ্বীপের কাছাকাছি গেলেই বারবার বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে এখানে আগন্তুক প্রবেশ নিষিদ্ধ। গোটা দ্বীপের বাসিন্দা ৫০-১০০ জনের মধ্যে। নব্বই দশকের মাঝামাঝি থেকে এই দ্বীপের সাথে সরকারি ভাবে সমস্ত যোগাযোগ স্থাপন বন্ধ করা হয় এবং পর্যটক নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয়।
সেন্টিনেলিরা পেরেছে আধুনিক ভয়ংকর নগর সভ্যতার গ্রাস থেকে নিজেদের সভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখতে। এই তথাকথিত নগর সভ্যতা বারবার ওদেরকে ‘হিংস্র’ বলে দাগিয়ে দিতে চেয়েছে। শেষ করে দিতে চেয়েছে ওদের সভ্যতাকে! ওরা তো শুধু নিজেদের সভ্যতা ও প্রকৃতি নামক সম্পদকে নিরাপদে আগলে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ওদের কথা শুনবে কে? ওদের বুঝবেই বা কে?
প্রচ্ছদ চিত্র ঋণ – https://pre-tend.com/
Discussion about this post