মিডিয়া জুড়ে একটি খেলো শব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘বুদ্ধিজীবী’। বুদ্ধির প্রভাব বা দার্শনিক মনোভাব নিয়ে হাসির আনাগোনা চলতেই থাকে। তবে আজ কথা হচ্ছে এমনই একজন মহিলা দার্শনিককে নিয়ে, যার দর্শন বদলে দিতে চেয়েছিলো গোটা সমাজকে। আর বদল আনতে চাওয়া মানুষগুলো অচিরেই হারিয়ে যায়। ঠিক তেমনই হত্যা করা হয়েছিল সেলিনা পারভীনকে।
সালটা ১৯৩১। ৩১ মার্চ বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলার রামগঞ্জের কল্যাণনগর গ্রামে জন্ম নেন সেলিনা পারভীন। পড়াশোনার পর কাজ বলতে শুরু করেন ‘ললনা’ পত্রিকার বিজ্ঞাপন বিভাগে লেখা। তার পাশাপাশি চালিয়ে যান তাঁর নিজস্ব পত্রিকা ‘শিলালিপি’ র সম্পাদনা। কিন্তু তাঁর এই কাজই তার কাল হল। ১৯৭১ এর ডিসেম্বর মাস। বাংলাদেশের উপর পাকিস্তানী হামলার কাল। ‘শিলালিপি’ র ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হলে তা নস্যাৎ করেন সেলিনা। মেরুদন্ড বেচতে তিনি রাজি নন।
সিদ্ধেশ্বরীর ১১৫ নং নিউ সার্কুলার রোডের বাড়িতে এক দুপুর। ছেলে জাহিদকে তেল মাখাচ্ছিলেন তিনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র ৩ দিন আগে ডিসেম্বরের ১৩ তারিখ। বাড়ির সামনে ইপিআরটিসি-এর ফিয়াট মাইক্রোবাস ও লরি থামলো। গাড়ি থেকে নামলো একই রঙের পোশাক পরা ও কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা কিছু আলবদর কর্মী। তারা বাড়ির ভেতরে ঢুকে সিঁড়ি বেয়ে সোজা উঠে আসে দরজার কড়া নাড়তে। সেলিনা দরজা খুলে দিল। তারা কিছুক্ষন কথা বলে নিশ্চিত হলো ইনিই সাংবাদিক সেলিনা পারভীন। এরপর তারা আর সেলিনাকে কোনো সময় দেয়নি। তৎক্ষণাৎ সেলিনাকে তারা ধরে নিয়ে গেল। সেলিনা পারভীন আর কখনো ফেরেননি।
সেদিন মায়ের সাথে ঠিক কী হয়েছিল জানতে ৩৫ বছর পার হয়ে গেছে জাহিদের। ১৮ ডিসেম্বর রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে তাঁর ছিন্ন বিচ্ছিন্ন মৃতদেহটি পাওয়া যায়। পায়ে তখনও পরা সাদা মোজা। তাঁর স্তন বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে তারপর কেটে ফেলা হয়েছিল। এরপর আজীমপুরের শহিদদের জন্য সংরক্ষিত কবর স্থানে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। তবে সেদিন তিনি একা ছিলেন না। সঙ্গে ছিলেন দেলোয়ার হোসেন। দেলোয়ার জাহিদের কাছে বলেন, সেলিনার জন্যই তিনি বেঁচে যান। তাকে মেরে ফেলার সময় পেছন থেকে হাত ছুটিয়ে চোখ খুলে সেই মুক্তিযোদ্ধা দৌড়ে পালিয়ে যেতে পেরেছিলেন। জাহিদ পরে দেলোয়ারের থেকেই জানতে পারেন তার মায়ের উধাও হয়ে যাওয়ার পেছনের রক্তাক্ত ইতিহাস। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রতি বছরই ১৪ ডিসেম্বরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।
Discussion about this post